শিরোনাম
◈ আজ রাত থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম টের পাবেন: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ◈ বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েসহ ১২ সড়ক-সেতুর নাম পরিবর্তন ◈ ঢাকাসহ সারা দেশে সন্ধ্যা থেকে যৌথ বাহিনীর প্যাট্রলিং ◈ ছিনতাই-ডাকাতি দমনে আজ থেকেই মাঠে যৌথ বাহিনী: আইজিপি ◈ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন বাংলাদেশে দুইজন সেনাপ্রধান  ◈ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি: মুখোমুখি অবস্থানে আন্দোলনকারী-পুলিশ (ভিডিও) ◈ রমজানে কমলো সরকারি অফিসের সময় ◈ স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি: বাসার গেট না খোলায় নিরাপত্তাকর্মী আটক ◈ ইলিয়াসকে সোহেল তাজের চ্যালেঞ্জ: প্রমাণ করো, না পারলে নাকে খত দিতে হবে ◈ দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় যে নির্দেশনা দিলেন সেনাপ্রধান (ভিডিও)

প্রকাশিত : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১:৫০ দুপুর
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৫:০৪ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘অফিসারদের মাথার দাম ৫ লাখ টাকা!’, জওয়ানরা একথা কেন বলল, আজও জানতে পারিনি

ইত্তেফাক প্রতিবেদন: ‘ঐ দিন কিছুক্ষণ পরপর বিডিআর জওয়ানরা বাসায় এসে দরজা ধাক্কাচ্ছিল। একপর্যায়ে তারা দরজা ভেঙে ফেলে। পুরো বাসা তল্লাশি করে টাকা ও প্রাইজবন্ড যা ছিল নিয়ে যায়। তখন আমার ছোট ছেলে বারবার জওয়ানদের কাছে জিজ্ঞাসা করছিল, আমার বাবা কেমন আছে? প্রথমবার কিছু না বললেও পরে যখন এসেছে, তখন একজন জওয়ান বলল, একজন অফিসারের মাথার দাম ৫ লাখ টাকা। সবার তো মুখ রুমাল দিয়ে বাধা ছিল, ফলে কে কথাটা বলেছে তার চেহারা দেখতে পাইনি। শুধু তার কথাটা কানে এলো। কেন একজন জওয়ান এই কথা বলল, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাইনি।’ ইত্তেফাককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন শহিদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সাইফুল ইসলামের স্ত্রী বেগম শাহীনুর পারভীন জবা।

শাহীনুর পারভীন বলেন, ‘আমি সেনা পরিবারের নই। সেনাবাহিনীতে আমার আসা সাধারণ পরিবার থেকে। এসেছিলাম লাল শাড়ি পরে। আর পিলখানা থেকে বের হয়েছিলাম সাদা শাড়িতে, বিধবা হয়ে। সেদিন কিন্তু আমি আমার সেনাবাহিনীকে পাইনি। অন্তর থেকে, মন থেকে যে সেনাবাহিনীকে ভালোবেসেছিলাম। শুধু সাংবাদিক ভাইদের সেদিন দেখেছি। তারাই আমাদের নিয়ে পিলখানা থেকে বের হয়েছিলেন।’

তিনি বলেন, তিন ছেলের মধ্যে ঐ দিন শুধু ছোট ছেলেই আমার সঙ্গে ছিল। বড় ছেলে ছিল ঢাকার বাইরে আর মেঝ ছেলে ছিল এমআইএসটিতে। ছোট ছেলে তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তিন ছেলের দুই জন বাবার আদর্শে বর্তমানে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আর বড় ছেলে ব্যাংক কর্মকর্তা। শাহীনুর পারভীন বলেন, এই ঘটনার পর আমি আর ছোট ছেলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অনেক কষ্ট হয়েছে।

ঐ দিনের সকালটা কীভাবে শুরু হয়েছিল? জানতে চাইলে শাহীনুর পরভীন বলেন, ‘সকালে নাস্তা করে দ্রুত সাইফ (স্বামী) বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ছোট ছেলেকে নিয়ে আমি বাসাতেই ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ শোনার পর সাইফকে ফোন করে বললাম কী হচ্ছে? বলল এখানে গণ্ডগোল হচ্ছে। আমি বললাম, সেক্টর কমান্ডারের বাসায় আগুন জ্বলছে। একটু পর আমার বাসায় সৈনিকরা আসে। দরজায় ধাক্কায়। পরে চলে যায়। সতর্ক করে সকাল ১০টায় ফোন করে সাইফ বলেছিল, তোমরা ভালো থেকো, সাবধানে থেকো। এরপর ছোট ছেলেকে চেয়ে নিয়ে কথা বলে সাইফ। বলে, বাবা তুমি ভালো থেকো। তুমি তোমার মাকে দেখে রেখো। আমাকে বলল, ছেলে বাইরে যেন না যায়। বলল, রেবকে বলছি, ক্যান্টনমেন্টে ফোন করছি, ওরা গাড়ি পাঠাবে। তোমরা চলে যেও। এরপর একাধিকবার ফোন করছি, এই যাচ্ছে, এই আসছে। কিন্তু গাড়ি আর আসেনি।’ 

তিনি বলেন, ‘সারা দিন সৈনিকরা দরজায় ধাক্কায়, এক পর্যায়ে দরজা ভাঙে। বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দেই। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ১০ জন লোক পাঁচটা অস্ত্র তাক করে আমার বুকে। আমি ভয়ে ওয়্যারড্রপ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ি। আমার ছোট ছেলে ওদের পা জড়িয়ে ধরে, বলে, আঙ্কেল, আমার মাকে কিছু বইলেন না, আমার আব্বুও কখনো মাকে কিছু বলেনি। ছেলে বারবার বাবার কথা জানতে চায়। এক পর্যায়ে একজন জওয়ান বলে, একজন অফিসারের মাথার দাম ৫ লাখ টাকা। রাতে যখন ওরা আবারও এলো, ছেলে বাবার কথা জানতে চাইলে, একজন জওয়ান বলে, কখন শেষ করে দিছি, কেউ বেঁচে নেই। তার কথা প্রথমে আমি বিশ্বাস করিনি। ভাবছিলাম একজন অফিসারকে ওরা মারবে কেন? আরেক জন জওয়ান আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তোরা তো বিডিআরে আসিস ফকিরের ঝোলা নিয়ে, এখান থেকে যাস টাকার ব্যাগ ভর্তি করে। চিকন চালের ভাত খাস। তখন আমি তাকে বলি, আমরা রেশনের চাল খাই। এরপর আমি তাকে বাসার চালও দেখাই। কিন্তু ওরা আমার কোনো কথাই শুনছিল না। শুধু আনন্দ আর উল্লাস করছিল।’  

সংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শাহীনুর বেগম বলেন, ‘বাসার গেট খুলে দেওয়ার পর আমি সেনাবাহিনীকে দেখিনি। অন্তর থেকে মন থেকে যে সেনাবাহিনীকে ভালোবেসেছিলাম। শুধু সাংবাদিক ভাইদের দেখেছি। তারাই আমাদের নিয়ে বের করেছেন। সাংবাদিক ভাইরা বলছিল, মরবো কিন্তু আপনাদের না নিয়ে যাব না। অথচ সেনাবাহিনীকে পেলাম না।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, পরদিন সন্ধ্যায় আমাদের বের করে নিউ মার্কেটের ভেতরে নেওয়া হয়। সেখানে রেবের একজন অফিসার বসা ছিলেন। ঐ অফিসার আমাকে ডাবের পানি খাওয়ার কথা বলেন। আমি বলেছি, অফিসাররা মরছে, আর আমি ডাবের পানি খাব? খাইনি।’

শাহীনুর পারভীন বলেন, ‘সাইফের লাশ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে এক অফিসার ফোন করে জানান, সাইফ স্যারের লাশ পাওয়া গেছে। ঐ ভাই আমাদের নিয়ে যাওয়ার পর সাইফকে কবরে নামানো হলো। সাইফের চেহারাটা দেখেছি, মুখটা দেখেছি, পেটে দেখি চারটা গুলির চিহ্ন। যে সাইফকে আমি সকালে নাস্তা করিয়েছি, সেই সাইফকে চিনতে পারিনি আমি। পেটে চারটা গুলি দেখে আমি ফিরে এসেছি, হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখিনি। বাবার লাশের মাথায় হাত বুলিয়েছে আমার বড় ছেলে। বাবার লাশকে খুঁজে বের করতে হয়েছে বড় ছেলেকে। সেই থেকে আজও কোথাও গোলাগুলি হলে ভয় পাই, আঁতকে উঠি।’

তিনি বলেন, ‘আমার কোনো দাবি নেই। শুধু চাই ন্যায়বিচারটা হোক। কেন আমার ৫৭ জন বোনকে বিধবার শাড়ি পরে পিলখানা থেকে বের হতে হলো? এই প্রশ্নটার উত্তর চাই। সত্যিটা অন্তত উদঘাটন হোক। শহিদ পরিবারের সদস্যরা অন্তত যেন ন্যায়বিচারটা দেখতে পারে। আজকে কথাগুলো বলতে পেরে মনে হচ্ছে বুকের পাথরটা সরে গেছে।’

প্রসঙ্গত, শহিদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সাইফুল ইসলাম ১৯৬০ সালের ১৯ অক্টোবর সিরাজগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া কোরে কমিশন লাভ করেন। চাকরি জীবনে তিনি ৬ ক্যাভালরি, ৪ হর্স, ১২ ল্যান্সার, বিডিআর ও সেনা সদর সাঁজোয়া পরিদপ্তরে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ সহায়তা মিশন পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘ অন্তর্বর্তীকালীন সহায়তা মিশন, অপারেশন সার্ক বন্ধন এবং মালদ্বীপে প্রেরিত টাস্কফোর্সে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষে তিনি বিডিআর সদর দপ্তর অপারেশন ও প্রশিক্ষণ পরিদপ্তরে জিএসও-১ পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। স্ত্রী ছাড়াও তার তিন পুত্রসন্তান রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়