সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য বা মিথ্যা তথ্যের বিস্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষকেরা আগে গণমাধ্যম–কেন্দ্রিক ভুল তথ্য বা গুজবের ওপর গুরুত্ব দিলেও, এখন রাজনৈতিক নেতা এবং দলের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব আমস্টারডামের দুজন অধ্যাপক গবেষণা করেছেন। গবেষণায় তাঁরা ২৬টি দেশের ৩ কোটি ২০ লাখ টুইট বিশ্লেষণ করেছেন। এসব টুইট বিশ্লেষণ করে তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভুল বা মিথ্যা তথ্য প্রচারের প্রবণতা পরীক্ষা করেছেন। বিশেষভাবে, কোন ধরনের রাজনৈতিক দল গুজব (ভুল বা মিথ্যা তথ্য) ছড়াতে বেশি আগ্রহী এবং তাদের আদর্শগত বৈশিষ্ট্য কীভাবে এই প্রবণতার সঙ্গে সম্পর্কিত সেটি পর্যবেক্ষণ করেছেন দুই অধ্যাপক।
গবেষণার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি
গবেষণাটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুজব ছড়ানোর প্রবণতা নির্ধারণের জন্য একটি তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ, পপুলিজমের (জনতুষ্টিবাদ) মাত্রা এবং তাদের সরকারে অংশগ্রহণের মতো ভিন্ন ভিন্ন উপাদান বিবেচনা করা হয়েছে।
গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ২৬টি দেশের ৮ হাজার ১৯৮ জন সংসদ সদস্যের টুইট বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষকেরা টুইটের সঙ্গে শেয়ার করা লিংকগুলো যাচাই করার জন্য Media Bias/Fact Check (MBFC) এবং Wikipedia Fake News List–এর মতো ডেটাবেইস ব্যবহার করেছেন। ভুল তথ্য চিহ্নিত করার জন্য শেয়ার করা ওয়েবসাইটগুলোর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর গড় নির্ভরযোগ্যতা স্কোর গণনা করা হয়েছে।
বিপুল পরিমাণ তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণা যে বিষয়গুলো পেয়েছে তার সারকথা হলো:
১. পপুলিজম এবং ভুল তথ্য
গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণভাবে পপুলিস্ট দলগুলোর ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা নেই। তবে, কট্টর ডানপন্থী পপুলিস্ট দলগুলো ভুল তথ্য ছড়ানোর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িত। পপুলিস্ট রাজনীতিবিদেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রচলিত গণমাধ্যমকে এড়িয়ে সরাসরি জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে চায়। এ ক্ষেত্রে, তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করার চেয়ে জনমত গঠনের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায় তাদের কাছে।
উল্লেখ্য, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য অনুযায়ী, ডানপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শ বা দল বলতে রক্ষণশীল রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত আদর্শ ও ব্যক্তিদের সংগঠন বোঝায়। এই শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি বিপ্লবের (প্রায় ১৭৯০–এর দশক) সংসদের আসন বিন্যাস থেকে, যেখানে রক্ষণশীল প্রতিনিধিরা সভাপতির ডানদিকে বসতেন। উনিশ শতকে এই শব্দটি সেই রক্ষণশীলদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, যারা কর্তৃপক্ষ, ঐতিহ্য এবং সম্পত্তির অধিকার সমর্থন করতেন। বিশ শতকে এটি একটি ভিন্ন ও চরমপন্থী রূপ ধারণ করে, যা পরে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর সঙ্গে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির সম্পর্ক অপরিহার্য নয়।
আর বামপন্থা হলো রাজনৈতিক দর্শনের সেই অংশ, যা সাধারণত সাম্যবাদ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণের বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। এই শব্দটির উৎপত্তি ১৭৯০–এর দশকে, যখন ফরাসি বিপ্লবী পার্লামেন্টে সমাজতান্ত্রিক প্রতিনিধিরা সভাপতির বামদিকে বসতেন।
বামপন্থীরা সাধারণত ঐতিহ্যবাহী অভিজাতদের স্বার্থের বিরোধিতা করেন, যার মধ্যে ধনী ও অভিজাত শ্রেণির লোকেরা অন্তর্ভুক্ত এবং শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থকে সমর্থন করেন। তাঁরা সামাজিক কল্যাণকে সরকারের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখেন। অধিকাংশ দেশে সমাজতন্ত্রই বামপন্থার প্রধান মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
২. বাম বনাম ডানপন্থী রাজনৈতিক দল
-ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত বেশি ভুল তথ্য ছড়ায়।
-বামপন্থী পপুলিস্ট দলগুলোর তুলনায় ডানপন্থী পপুলিস্ট দলগুলো ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্রিয়।
-গবেষণায় দেখা গেছে, ডানপন্থী দলগুলো, বিশেষ করে যেগুলো উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বিদেশ–বিরোধী মনোভাব প্রচার করে, তারা ভুল তথ্যকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে।
-অন্যদিকে, বামপন্থী দলগুলো সাধারণত অর্থনৈতিক ইস্যু ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে বেশি মনোযোগী থাকে এবং তারা তুলনামূলকভাবে ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে কম সক্রিয়।
৩. গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক
-কট্টর ডানপন্থী দলগুলো মূলধারার গণমাধ্যমকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না এবং তারা বিকল্প তথ্যের উৎস তৈরি করে।
-বামপন্থী পপুলিস্ট দলগুলো অর্থনৈতিক সমস্যা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ে বেশি মনোযোগী হয়, তাই তারা ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়।
-গণমাধ্যমে আস্থা কমে যাওয়ার কারণে, অনেক মানুষ ভুল তথ্য বিশ্বাস করে এবং এভাবে ভুল তথ্য আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
৪. মিথ্যা তথ্যের রাজনৈতিক প্রভাব
-ভুল তথ্য রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে নির্বাচনের সময়।
-কট্টর ডানপন্থী দলগুলো ভুল তথ্য ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাব তৈরি করতে চায়।
-ভুল তথ্য ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই গবেষণাটি দেখিয়েছে, ভুল তথ্য শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমস্যা নয়, বরং এটি রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। কট্টর ডানপন্থী দলগুলোর ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও প্রচারের কৌশলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। তারা মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থা কমানোর উদ্দেশ্যে তথ্যের জন্য বিকল্প উৎস ব্যবহার করে।
এ ছাড়া, ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে তারা নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে চায়। এই গবেষণার ফলে ভবিষ্যতে ভুল তথ্য মোকাবিলায় নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের জন্য কার্যকর কৌশল নির্ধারণে সহায়তা করবে।
অবশ্য এই গবেষণা শুধু টুইটার বা এক্সের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম, যেমন: ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদিতে রাজনৈতিক ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে, সেটি আরও বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে টিকটকের প্রভাবের কথা খোদ ডোনাল্ড ট্রাম্পও স্বীকার করেছেন। ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী পুরো সময় ট্রাম্পের সমর্থকেরা টিকটকের ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন।
এ ছাড়া গবেষণাটি মূলত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ডেটার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে। গবেষকেরা বলেন, ভুল তথ্যের প্রভাব এবং ব্যবহার স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে।
ভুল তথ্য কীভাবে ভোটারদের মনোভাব এবং আচরণ পরিবর্তন করে, তা নিয়ে সেভাবে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা এখনো হয়নি। বিশেষ করে, কোন ধরনের মানুষ ভুল তথ্য বেশি বিশ্বাস করে এবং তারা কীভাবে এটি যাচাই করে, সে বিষয়টি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।
এরপরও এই গবেষণার ফলাফল ইঙ্গিত দেয়, রাজনৈতিক ভুল তথ্য শুধু একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমস্যা নয়, এটি বিশেষত কট্টর ডানপন্থী পপুলিস্ট দলের একটি রাজনৈতিক অস্ত্র। রাজনৈতিক নেতারা যখন ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়, তখন এটি শুধু জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতেই নয়, বরং সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন প্রকাশনা সংস্থার সাময়িকী সেইজ জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ: আজকের পত্রিকা