বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করতে পারে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে বৃটেনের প্রভাবশালী মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানচেট গতকাল একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক পরিচালক মুকেশ কপিলা বলেছেন, সায়মা ওয়াজেদকে ঘিরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাবমূর্তিতে লেজেগোবরে অভিজ্ঞতা দেখা দিয়েছে। এটা শুধু এই অঞ্চলের জন্যই নয়, বিশ্বব্যাপী এমন প্রভাব পড়েছে। অবশ্যই এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতাকে খর্ব করেছে। একই সঙ্গে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মতো মানুষদের জন্য খোরাক হয়েছে, যারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র তারিক জাসারেভিচ বলেন, যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো সদস্য দেশ দ্বারা বা তাদের ভিতরে অন্যায়ের অভিযোগ থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট জাতীয় কর্তৃপক্ষ এর তদন্ত করতে পারে যথার্থভাবে। এসব তদন্ত বা কোনো আইনগত বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো মন্তব্য করবে না। ল্যানচেটে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতায় ঘাটতি ছিল সায়মা ওয়াজেদের। তার চেয়ে বেশি যোগ্যতা ছিল নেপালের প্রার্থী শম্ভু প্রসাদ আচার্য্যের।
কিন্তু সায়মা ওয়াজেদের মা, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মেয়ের প্রোফাইল উন্নত করেছেন। এসব নিয়ে তদন্ত করছে দুদক। ল্যানচেট তার রিপোর্টে বলেছে, দুর্নীতিপরায়ণ প্র্যাকটিসের মাধ্যমে তার পদ নিশ্চিত করেছেন সায়মা ওয়াজেদ- এমন অভিযোগ তদন্ত করছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক নিয়োগ করা হয়। অভিযোগ আছে, সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতায় ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তার মা অনৈতিক উপায়ে ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন নিজের মেয়েকে ওই পদে বসানের জন্য। দুদকের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম এসব কথা জানিয়েছেন দ্য ল্যানচেট’কে।
এ অভিযোগ জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখেছে দুদক। তাতে সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তিনি আর্থিক অসদাচরণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহার করেছেন। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সায়মা ওয়াজেদকে সরানোর জন্য ওই দুই মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দুদক। তারা অভিযোগ করেছে শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক অবস্থানকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে নিজের কন্যার প্রোফাইলকে উন্নত করার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে আছে ২০২৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে রাষ্ট্রীয় সফরে হাইপ্রোফাইল সফরে সায়মা ওয়াজেদকে তিনি সঙ্গে নিয়েছেন।
সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতায় ঘাটতি থাকা এবং আত্মীয়করণের বিষয়টি তাকে নিয়োগের ক্ষেত্রে সমালোচিত করেছে। দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে সায়মা ওয়াজেদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় নিয়োগ পাওয়ার শর্তগুলো যথাযথভাবে পূরণ করেছেন কিনা অথবা এ প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাবের কারণে তিনি পছন্দের প্রার্থী ছিলেন কিনা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক কমিটির রুলস অব প্রসিডিউরের ৪৯ নম্বর নিয়মে বলা হয়েছে- আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে যারা প্রার্থী হবেন, তাদের থাকতে হবে শক্তিশালী প্রযুক্তিগত এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ব্যাকগ্রাউন্ড, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা এবং জনস্বাস্থ্যে নেতৃত্ব দেয়া ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ। ল্যানচেট লিখেছে, সায়মা ওয়াজেদের আছে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিষয়ে এমএসসি ডিগ্রি। কিন্তু এ ছাড়া তার কোনো আনুষ্ঠানিক মেডিকেল বা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক একাডেমিক যোগ্যতা নেই।
২০২৩ সালে তিনি বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। অটিজম এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করায় তার বৈশ্বিক স্বাস্থ্যে সীমিত কাজের অভিজ্ঞতা আছে। এর মধ্যে আছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং চ্যাথাম হাউসে উপদেষ্টার ভূমিকা। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নেপালের শম্ভু প্রসাদ আচার্য্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তার কাজ করার কমপক্ষে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। আছে জনস্বাস্থ্যে একটি ডক্টরেট ডিগ্রি। জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক পরিচালক ছিলেন মুকেশ কপিলা। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও মানবতা বিষয়ক প্রফেসর।
তিনি দ্য ল্যানচেটকে বলেছেন- তার (সায়মা ওয়াজেদ) নিয়োগ নিয়ে তদন্তের অধিকার আছে দুদকের। কাশ্মীরে স্বাস্থ্য বিষয়ক সাবেক মহাপরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সালিমউর রেহমান বলেন- আঞ্চলিক পরিচালকের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিষয়ে নেতৃত্বের রেকর্ড থাকা উচিত। অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য এসব যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক আরও কিছু পরিচালক কেলেঙ্কারি মোকাবিলা করেছেন। ২০২৩ সালের মার্চে ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক অঞ্চলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক তাকেশি কাসাই’কে বরখাস্ত করা হয়। অনুবাদ: মানবজমিন।
আপনার মতামত লিখুন :