পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
আজ বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে এমনই এক অভিযোগ তোলে এই মার্কিন মানবাধিকার সংস্থাটি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ও মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদনে নিউইয়র্কভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠনটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ গাজার মানুষদের জন্য সেখানে জরুরি পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিমাণ পানিও সরবরাহ করতে দেয়নি। শুধু এ কারণেই উপত্যকাটির হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। ছড়িয়ে পড়েছে নানা ধরনের রোগ।
এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় এমনকি ন্যূনতম এই পরিমাণ পানিও জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। গাজাবাসীদের আওতায়ধীন এলাকায় থাকা পানি সরবরাহের প্রায় পুরোটাই পান অযোগ্য। এমনকি, সদ্যোজাত যেসব শিশু মায়ের অপুষ্টির কারণে বুকের দুধ পায় না, তাদেরকেও এই দূষিত পানিতে মেশানো খাবার খাওয়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ড জেনোসাইড কনভেনশন ও রোম স্ট্যাটিউট অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি) লঙ্ঘন। পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে গাজাবাসীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি চিকিৎসা‑খাদ্য সহায়তাসহ সব ধরনের মানবিক সহায়তাকেও বাধা দেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য পরিচালক লামা ফাকিহ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ইসরায়েলি সরকার গাজায় ফিলিস্তিনিদের প্রয়োজনীয় পানি থেকে বঞ্চিত করে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের হত্যা করছে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বিল ভ্যান এসভেল্ড কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘তদন্তের অংশ হিসেবে ১১৫ জনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে এবং স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছে এই সংগঠনটি। তদন্তে আমরা চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুঁজে পেয়েছি।‘
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েল থেকে গাজায় পানীয় পানি সরবরাহকারী পাইপলাইনগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর ইসরায়েল বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, যা গাজায় পানির পাম্প এবং রিজার্ভ চালু রাখতে প্রয়োজন। ফলে পানিশোধন প্ল্যান্ট, পানি কূপ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্টগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে।‘
ভ্যান এসভেল্ড আরও যোগ করে বলেন, ‘তাদের মধ্যে কিছু স্থাপনায় সৌর প্যানেল ছিল, যা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকলে বিকল্প শক্তি হিসেবে কাজ করত। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এরপর গাজার ছয়টি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্টের মধ্যে চারটির সৌর প্যানেল সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়।
শেষ পর্যন্ত তারা যেকোনও ধরনের মেরামত প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করেছে প্রযুক্তিগত কর্মীদের হত্যা এবং মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলিকে পানি-সম্পর্কিত সরঞ্জাম আনতে বাধা দিয়ে।‘
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বলেন, ‘এর মানে হলো আপনি এমন পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করছেন যা আপনি জানেন যে, একটি জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশকে হত্যা করবে।‘
এ প্রতিবেদনে আরও কিছু তথ্য উঠে এসেছে, গাজার ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন মাত্র ২ থেকে ৯ লিটার পানির অ্যাক্সেস পাচ্ছে, যা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫ লিটারের ন্যূনতম সীমার নিচে। এর ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে এবং মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই নীতি ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনে উল্লিখিত গণহত্যার কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে বলেও এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গাজার ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন জীবনযাত্রার শর্ত আরোপ করেছে, যা তাদের শারীরিক ধ্বংস সাধনে পরিকল্পিত।
এদিকে ইসরায়েল বারবার গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এছাড়া এইচআরডব্লিউ-এর প্রতিবেদনের ফলাফলকে ভয়াবহ মিথ্যা বলে অভিহিত করেছে ইসরায়েল।
অপরদিকে জার্মানির সরকারি সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের ১৩ সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশনে ইসরায়েলের পক্ষে লেখার জন্য তাদের ভয়ভীতি এবং চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ ছাড়া অফিসের ভেতর ফিলিস্তিনিবিরোধী এবং ইসলামবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড কোনো বাধা ছাড়াই করা হয় বলে জানিয়েছেন তারা।
এছাড়া আলজাজিরার হাতে আসা একটি নথিতে দেখা গেছে, ডয়চে ভেলের কর্মীদের সংবাদ লেখার সময় ‘ফিলিস্তিনি’ শব্দটি ব্যবহার না করতে উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারণ ফিলিস্তিন এখনও স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি। তাই ফিলিস্তিনের জায়গায় ‘ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড’ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলার প্রত্যুত্তরে গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। এখন পর্যন্ত ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। ফলে মানবিক কারণে বিশ্ববাসীর তরফ থেকে শান্তিপ্রক্রিয়ার নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও এ যুদ্ধ থামায়নি নেতানিয়াহুর সরকার। এতে বেশির ভাগ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং গাজা অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :