মহসিন কবির: ভারতে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতালগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছে। হাসপাতাল কর্তপক্ষের কেউ বলেছেন বাংলাদেশিদের চিকিৎসা দেবেন না। কেউ বলেছেন একজন মানুষ যদি অসুস্থ হয় সে আমার শত্রু হলেও আমি তাকে সুস্থ করব। এসব পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে অসহায় হয়ে পড়েছে রোগীরা। ফেসবুকে দুই বাংলা অনেকেই বলেছেন রোগী নিয়ে রাজনীতি হোক।
উত্তর কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের তরফেও বাংলাদেশি রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া বন্ধ রাখার কথা জানানো হয়েছে। এদিকে চিকিৎসকদের বাংলাদেশি রোগীদের বয়কটের ডাক দিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষও ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর কলকাতার মানিকতলা এলাকার জেএন রায় হাসপাতাল বলেছে, তারা আর বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেবে না। বাংলাদেশে ভারতীয় পতাকার অবমাননা এবং দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর ‘অত্যাচারের’ প্রতিবাদে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার (৩০ নভেম্বর) জেএন রায় হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে দেশটির বার্তা সংস্থা পিটিআই এ তথ্য জানিয়েছে।
পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের জেএন রায় হাসপাতাল অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা করবে না বলে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। জেএন রায় হাসপাতালের কর্মকর্তা শুভ্রাংশু ভক্ত বলেন, আমরা একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছি যে আজ থেকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আমরা কোনো বাংলাদেশি রোগীকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করবো না। ভারতের পতাকা অবমাননার প্রতিবাদে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত অত্যাচারের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে কলকাতার অন্যান্য হাসপাতালগুলোকেও একই ধরনের পদক্ষেপ (বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ) নেওয়ার আহ্বান জানান শুভ্রাংশু ভক্ত। তিনি বলেন, পতাকার অপমান হচ্ছে দেখে আমরা বাংলাদেশিদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তাপরও আমরা বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাক প্রত্যক্ষ করছি। আমরা আশা করি অন্যোন্য হাসপাতালও আমাদের সমর্থন করবে এবং একই ধরনের পদক্ষেপ নেবে।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ এনে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের কথা ভাবা হচ্ছে। শনিবার (৩০ নভেম্বর) ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। ভারতের আসাম থেকে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা দ্য আসাম ট্রিবিউনের অনলাইন প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তিনি বলেন, তবে আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। তবে পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে যে কোনো কিছু ঘটতে পারে।
মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা বলেছেন, ‘হিন্দু সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে হামলা-নিপীড়ন বন্ধের কোনো আভাস নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর খড়্গ নেমে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘যেদিনই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়েছেন, সেদিনই আমরা সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছি। আমি বিএসএফ কর্মকর্তা ও পুলিশের মহাপরিচালকের সঙ্গে কয়েকবার বসে ব্যক্তিগতভাবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছি। আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার সীমান্তের নিরাপত্তা।
ত্রিপুরার আইএলএস হাসপাতালও বাংলাদেশিদের চিকিৎসা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শনিবার তারা এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, বাংলাদেশিদের চিকিৎসাসেবা না দেওয়ার দাবিতে স্থানীয়রা ওই হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করেন। পরে আইএলএস হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা না করার ঘোষণা দেয়। আইএলএস হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার ভারতীয় বার্তাসংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশিদের চিকিৎসা করানো বন্ধ করা নিয়ে স্থানীয়রা যে দাবি তুলেছেন, তার সঙ্গে আমরা একমত। আখাউড়া চেকপোস্টে ও আইএলএস হাসপাতালে তাদের জন্য যে হেল্প ডেস্ক ছিল, সেটিও এবার বন্ধ করা হলো।
বাংলাদেশি রোগী দেখা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতার খ্যাতনামা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রনীল সাহা। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে একথা জানিয়েছেন তিনি। সঙ্গে শহরের অন্য চিকিৎসকদেরও এই পথে হাঁটার আবেদন জানিয়েছেন ইন্দ্রনীলবাবু।
এদিকে বাংলাদেশে ভারতের জাতীয় পতাকা অবমাননার প্রতিবাদে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কলকাতার একাধিক চিকিৎসক ও বেসরকারি হাসপাতাল। তবে চিকিৎসকদের একাংশের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন কলকাতার মেয়র তথা পশ্চিমবঙ্গের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। ফিরহাদ বলেন, বাংলাদেশে একটা অরাজক অবস্থা চলছে। চারিদিকে একটা বিশ্রী অবস্থা চলছে। সেজন্য হয়তো রোগীরা তেমন আসছেন না।
কিন্তু কেউ বৈধ পথে এসে চিকিৎসা পাননি এরকম কোনও খবর নেই। তিনি বলেন, কেউ ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা করা বন্ধ রাখতে পারেন। কিন্তু একজন মানুষ যদি অসুস্থ হয় সে আমার শত্রু হলেও আমি তাকে সুস্থ করব। এটাই চিকিৎসকের ধর্ম। সেখানে আমাদের মানবিকতায় বাধা হবে না। তার মতে, আমাকে কেউ খুন করতে এলেও তার চিকিৎসার দরকার হলে চিকিৎসা দিতে হবে।
এদিকে নাম বলতে না চাওয়ার শর্তে কলকাতার অন্য একটি নামজাদা বেসরকারি হাসপাতালের সিইও দাবি করেন, যে হাসপাতাল বয়কটের ডাক দিয়েছে, কলকাতার মেডিকেল ট্যুরিজম সেক্টরে তার অবদান কিছুই নেই। বাংলাদেশ থেকে এই হাসপাতালে কোনদিনই রোগী যায় না দাবি করে ওই সিইও আরও বলেন, স্থানীয় রোগী পেতেই হিমশিম খেতে হয় এই হাসপাতালকে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও জারি করে নাম কুড়ানোর চেষ্টা করছে হাসপাতালটি।
আপনার মতামত লিখুন :