আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প একে অপরকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে এক সমাবেশে ট্রাম্প এবং মোদি একে অপরকে প্রকাশ্যে প্রশংসা করেন। যেখানে প্রায় ৫০ হাজার ভারতীয়-আমেরিকান উপস্থিত ছিলেন। পরে ২০২০ সালে মোদি নিজ রাজ্য গুজরাটে ট্রাম্পকে আরও বড় সমাবেশে স্বাগত জানান। সেখানেও মোদির প্রশংসা করেন তৎকালীন মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (০৫ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন মসনদে বসতে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এদিন ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ও পপুলার ভোট—দুই হিসাবেই হারিয়ে দেন তিনি। জয়ের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক্সে করা এক পোস্টে বলেছেন, "আপনার (ট্রাম্প) পূর্ববর্তী মেয়াদের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে আমি ভারত-মার্কিন ব্যাপক বৈশ্বিক এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করতে এবং আমাদের সহযোগিতার পুনর্নবীকরণের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।" তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর নেয়া পররাষ্ট্রনীতির ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়াবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প আবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক বিরোধ তাদের উষ্ণ সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। প্রথম মেয়াদে নয়াদিল্লির প্রতি মাঝে মাঝে আক্রমণাত্মক কথাও বলেছিলেন ট্রাম্প। ভারতকে "শুল্ক রাজা" এবং "বাণিজ্য অপব্যবহারকারী" বলে আখ্যায়িত করলে দুই দেশের সম্পর্কে ছেদ পড়ে। পরে তা স্বাভাবিক হলেও ট্রাম্প এবার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দেশগুলোর ওপর "পারস্পরিক" শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির কিছু শিল্পে প্রভাব ফেলতে পারে।
দিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক আনান্তা অ্যাস্পেন সেন্টারের প্রধান নির্বাহী ইন্দ্রাণী বাগচী মনে করেন, "ট্রাম্প যেদিকে আমেরিকাকে নিয়ে যেতে চান তা অর্থনৈতিক এবং শিল্প কার্যক্রমকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনার দিকেই যাচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে আমেরিকা এই ধারণা করে আসছে, পণ্য অন্য কোথাও উৎপাদিত হবে এবং সেগুলো সস্তায় পাওয়া যাবে। তবে এখন উৎপাদন যদি সত্যিই আমেরিকায় ফিরে যায়, তাহলে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকা দেশগুলোর জন্য এর মানে কী হবে?"
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ছিল ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। পাশাপাশি মোদি সরকার "মেক ইন ইন্ডিয়া" উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে।
এদিকে অ্যাপলসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি সরবরাহ শৃঙ্খলা চীনের বাইরে স্থানান্তর করা শুরু করেছে। টিসিএস এবং ইনফোসিসের মতো ভারতের বৃহত্তম প্রযুক্তি কোম্পানি মার্কিন কোম্পানিগুলোর তথ্যপ্রযুক্তি চাহিদা পূরণের জন্য সাশ্রয়ী শ্রমশক্তি সরবরাহের মাধ্যমে কর্পোরেট জায়ান্টে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্যপ্রযুক্তি সেবা আউটসোর্সিং করে উল্লেখযোগ্য ব্যয় সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছে, আর এতে ভারতীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিশ্ববাজারে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে।
ব্যবসায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এশিয়া গ্রুপের আশোক মালিক বলেন, ট্রাম্প যদি চাকরি দেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন এবং "শুল্ক যুদ্ধ" শুরু করেন, তবে ভারতের প্রযুক্তি খাতেও এর প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের আক্রমণাত্মক বাণিজ্য নীতি এবারও মূলত চীনের দিকে লক্ষ্য করা হলেও ভারতও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না।
কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক হর্ষ পান্ত মনে করেন, দুই নেতার ব্যক্তিগত উষ্ণ সম্পর্ক থেকে ভারত উপকৃত হতে পারে। কারণ মোদি এমন এক শক্তিশালী নেতা, যাকে ট্রাম্প পছন্দ করেন। মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক, দৃশ্যত ভালো এবং মোদির জন্য অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে, যা তিনি কাজে লাগাতে পারেন।
অভিবাসন 'পিআর বিপর্যয়'
আগামী বছরগুলোতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উষ্ণতায় কূটনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ অভিবাসনের অন্যতম বৃহৎ উৎস ভারত, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাজার হাজার ভারতীয় কানাডা ও মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। এ বিষয়ে কঠোর নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ইন্দ্রাণী বাগচী বলেছেন, "যদি ভারতীয়দের গণহারে আটক ও নির্বাসন করা হয়, তাহলে এটি একটি বড় পিআর বিপর্যয় তৈরি করবে।"
ভারতের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রিয়াজ মনে করেন, বিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় কিছু সুবিধা পেতে পারে ভারত। কারণ প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক ভালো। এছাড়া ঐতিহাসিকভাবে বিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সবসময়ই ডেমোক্রেটিক পার্টির শাসনামল থেকে উষ্ণ। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, কূটনীতিক সম্পর্কের বাইরেও মোদি-ট্রাম্পের মধ্যে জনসম্মুখে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অভিবাসী বা অন্য ইস্যুতে ট্রাম্প যখন সিদ্ধান্ত নিবেন তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতের ওপরও প্রভাব ফেলবে এটা সত্য, তবে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হওয়ায় ভারত সেসব ইস্যুতে বেশি সুবিধা আদায় করতে পারবে।
ড. রিয়াজ বলেন, সম্প্রতি ভারতের মানবাধিকার বা খালিস্তানি ইস্যুতে সরব ছিল মার্কিন প্রশাসন। ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর সেগুলো নিয়ে মোদির চাপ কমতে পারে। পাশাপাশি ট্রাম্পের রানিং মেট বা হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের স্ত্রী উষা ভ্যান্সের পূর্বপুরুষের বাড়ি ভারতে। সব ঠিক থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেকেন্ড লেডি’ হতে চলা উষার স্বামী ভারতের 'জামাই' হিসেবে আখ্যা পাবেন। আগে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও এখন প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট দুজনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক হবে ভারতের, তার সুবিধা পেতে পারে মোদি সরকার। এছাড়া এই অঞ্চলে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একত্রে করতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের সাথে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড জোটের সদস্য ভারত। মূলত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে মোকাবিলা করার উপায় হিসাবে দেখা হয়। তবে ট্রাম্পের "অনির্দেশ্যতা" সবসময় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার এই গতিপথ অব্যাহত থাকবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অধ্যাপক হর্ষ পান্ত বলেন, "ট্রাম্প বিশ্বকে কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন না বরং তার দৃষ্টিভঙ্গিতে সবসময় একটি লেনদেনমূলক মনোভাব থাকে- যা বিষয়টিকে জটিল এবং অনিশ্চিত করে তোলে।"
কলকাতার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা ড. মীরাতুন নাহার মনে করেন, ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গঠনকামী কূটনীতিবিদ কিনা সে সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। তাই ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের এই জয় একধরনের আশঙ্কা তৈরি করেছে মনের মধ্যে। অন্যদিকে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে দলীয় রাজনীতি করেন, তা ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের সঙ্গে বেমানান। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মীয় বৈষম্যের বীজ বপন করে তার দল স্বদেশের মহিমা ক্ষুণ্ণ করে চলেছে। বলা যায়, এই দুই ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক ভূমিকা গঠনমূলক নয়। তাই এমন দুইজন ব্যক্তির সখ্যতা থাকা, বা কাছাকাছি আসার মাধ্যমে ক্ষমতার ক্ষমতা দেখানোর ক্ষতিসাধক পরিস্থিতির মধ্যে দুই দেশবাসীকেই পড়তে হতে পারে।
সুত্র : চ্যানেল ২৪
আপনার মতামত লিখুন :