এই লেখাটি যখন তৈরি হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ৪ নভেম্বরের রাত সাড়ে ৯টা। বাংলাদেশ ততক্ষণে ৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দেখা পেয়েছে। লেখাটি যখন ছাপা হবে ততক্ষণে মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল একটু একটু করে প্রকাশ পেতে থাকবে। বিজয়ের পাল্লা কমলা হ্যারিস নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকছে, সেটা আজকের পত্রিকার পাঠক ততক্ষণে জেনে যাবেন।
তাই এই লেখাটি তৈরি হবে নির্বাচনের আগের কিছু কথা নিয়ে। কোন কথা ফলল, তা এই লেখা দেখে সবাই একটু ঝালিয়ে নিতে পারেন। মিলিয়ে দেখতে পারেন, জয়ের ব্যাপারে যে ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো ফলছে কি না।
ট্রাম্পের বিজয়ের ব্যাপারে পাঁচটি কারণ দেখানো হয়েছিল। প্রথমেই বলা হয়েছিল, দেশজুড়ে এই মুদ্রাস্ফীতির কালে ট্রাম্প ক্ষমতায় নেই, সেটাই তাঁর বিজয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। দেশের অর্থনীতি যে ভালো নেই, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। প্রতিদিন বাড়তি মূল্য দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার কারণে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টের প্রতি নাখোশ হচ্ছে জনগণ। করোনার মতো ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্নের পর মুদ্রাস্ফীতি যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা সত্তরের দশকের পর যুক্তরাষ্ট্র আর কখনোই দেখেনি। এ কারণেই ট্রাম্প জনগণকে এই প্রশ্নটি স্বচ্ছন্দে করতে পারছেন, ‘আপনারা কি চার বছর আগের তুলনায় এখন ভালো আছেন?’
না, ভালো নেই। চার বছর আগেই তো ট্রাম্প ক্ষমতা হারিয়েছিলেন বাইডেনের কাছে।
২০২৪ সালে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। করোনার প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতি তার একটি বড় কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের এক-চতুর্থাংশ মানুষ কেবল দেশের অগ্রগতি হচ্ছে বলে মনে করেন। বাকিরা চাইছেন এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।
ট্রাম্পের একটা ইতিবাচক দিক হলো, নানা ধরনের স্ক্যান্ডালের পরও তাঁর জনপ্রিয়তা কখনো ৪০ শতাংশের নিচে নামেনি। ২০২১ সালে ক্যাপিটলের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা হওয়ার পরও ৪০ শতাংশ মানুষ তাঁর ওপর সমর্থন বজায় রেখেছে। যখন ডেমোক্র্যাটরা এবং রিপাবলিকান দলের একটি অংশ ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য বলে মনে করছেন, তখন রিপাবলিকান সমর্থকেরা ট্রাম্পকে ‘উইচ হান্টিং-এর শিকার’ বলে মনে করছেন। জনমত জরিপে কমলা আর ট্রাম্পের অবস্থান সমানে সমান। তাই ট্রাম্প আক্রোশের শিকার—এই কথা প্রচার করতে পারলে এবং এ কারণে তাঁর দিকে দোদুল্যমানদের ভোট গেলে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা আছে।
অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ট্রাম্পকে ভোটারদের বহুলাংশে সমর্থন করে। বাইডেনের শাসনামলে অবৈধ অভিবাসীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে, এটাই ট্রাম্পের জন্য ট্রাম্প কার্ড হয়ে উঠতে পারে।
উচ্চশিক্ষিত নন, এ রকম ভোটাররা একটু বেশি সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে ট্রাম্পের ভাগ্য খুলবে। এই শ্রেণির মানুষই মনে করে থাকেন, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তাঁদের মনে রাখেনি সরকার। ফলে তাঁদের ভোট অবধারিতভাবে যাবে ট্রাম্পের দিকে। সম্প্রতি দেখা গেছে, এ কারণেই ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নেতৃত্ব ডেমোক্র্যাটদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, রিপাবলিকানরা সেখানে জায়গা করে নিচ্ছেন।
গ্রাম ও উপশহরের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে পারলে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দিকে পা বাড়িয়ে রাখতেই পারেন।
অস্থিতিশীল হয়ে আছে পৃথিবী। এ সময় শক্তিশালী নেতৃত্ব পছন্দ করে মানুষ। এই হিসেবে ট্রাম্পকে শক্তিশালী মানুষ হিসেবেই মনে করে থাকেন বিশ্বনেতারা। ট্রাম্প বলে থাকেন, তিনি হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন কোনো বড় যুদ্ধে জড়ায়নি যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বহু মার্কিন নাগরিক এ সময় ইউক্রেন ও ইসরায়েলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা অপচয় করছে বলে বাইডেনের প্রতি নাখোশ হয়ে আছেন।
পুরুষ ভোটারদের এক অংশ স্রেফ পুরুষ হওয়ার কারণেই ট্রাম্পকে ভোট দেবেন।
এ তো গেল ট্রাম্পের পক্ষের কথা। কমলার বিজয়ের পক্ষেও রয়েছে এ রকম পাঁচটি কারণ। একেবারে প্রথম কারণটি হলো, কমলা ট্রাম্প নন। ট্রাম্পের মতো যখন-তখন যেকোনো কথা বলে ফেলেন না তিনি। যা বলেন, যুক্তি দিয়ে ভেবেচিন্তে বলেন। ২০২০ সালে যখন রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন ট্রাম্প, তখন সে নির্বাচনে কিন্তু ৭০ লাখ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন বাইডেন। আর এবার কমলা হ্যারিস তো বলে যাচ্ছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় গেলে কী সর্বনাশই-না হবে যুক্তরাষ্ট্রের। ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলেও প্রচারণা চালিয়েছেন কমলা। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই মনে করেন, দেশটি বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। এই ভোটারদের কেউ কেউ যদি দেশকে নির্দিষ্ট পথে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কমলার ওপর নির্ভর করে থাকেন, তাহলে কমলার জয় ঠেকানো যাবে না।
কমলা বাইডেনও নন। এটাও তাঁর একটি ইতিবাচক দিক। বাইডেন যদি শেষপর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকতেন, তাহলে ডেমোক্র্যাট শিবির মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যেত যে ট্রাম্পই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। বাইডেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডেমোক্র্যাটরা সংঘবদ্ধ হয়ে কমলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে নির্ঘাত পরাজয়ের জায়গায় নিজেরা আবারও জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে।
নারীদের ব্যাপারে ইতিবাচকভাবে সোচ্চার কমলা। দেশের নারী ভোটারদের বহুলাংশই কমলাকে ভোট দেবেন। ২০২২ সালে গর্ভপাতবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে। ফলে নারীরা তাঁদের সুস্পষ্ট অবস্থান নিশ্চয়ই পরিষ্কার করতে চাইবেন এই নির্বাচনে। তা ছাড়া দেশ প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে—এই জায়গা থেকেও নারীদের ভোট কমলার দিকে যাবে।
বলা হচ্ছে, বর্ষীয়ান মানুষ ও উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভোট যাবে কমলার বাক্সে। এই শ্রেণির মানুষ ভোটকেন্দ্রে এসে থাকেন। অপর দিকে ট্রাম্প মূলত তরুণ ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়। এই তরুণ ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনীহ থাকে। নিউইয়র্ক টাইমস/সিয়েনা পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, কমলা ট্রাম্পের কাছে পিছিয়ে আছেন সেই শ্রেণির ভোটারদের কারণে, যাঁরা নিবন্ধিত ভোটার কিন্তু ২০২০ সালে ভোট দিতে যাননি।
আরও একটি কারণে কমলা জয়ী হতে পারেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে অনেক টাকা খরচ করেছেন। কমলা নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছেন জুলাই মাসে, এরপরই তিনি নির্বাচনী তহবিল হিসেবে এই টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। অপর দিকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকেই ট্রাম্প নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করছিলেন। কিন্তু কমলার মতো এত টাকা সংগ্রহ করতে পারেননি।
দুই দিকের যুক্তিগুলো দেওয়া হলো। এই লেখা পড়ার সময়ই হয়তো যুক্তিগুলোর কোনটি বাস্তবিক অর্থে কাজ করেছে, তা জেনে যাবেন আপনি। জেনে যাবেন, পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন। ত্র : আজকের পত্রিকা
আপনার মতামত লিখুন :