হঠাৎ করেই দিল্লির বিবিসি’র প্রধান কার্যালয়ে আমন্ত্রণ। ভারতের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রেই এই আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাটির অফিস। প্রবেশ মুখে বেশ ভালোই সিকিউরিটি ব্যবস্থা। তা পেরিয়ে অফিসে প্রবেশ করতেই বোঝা গেল পূজার ছুটির আমেজ লেগেছে। সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিবিসি’র বাংলা বিভাগের বিশেষ প্রতিনিধি শুভ জ্যোতি ঘোষ। নিজেই কফি বানিয়ে আনলেন, জমে উঠলো আড্ডা। বিষয় আর কী! ‘বাংলাদেশ’ আর বাংলাদেশের ক্রিকেট। তিনি কলকাতার মানুষ, তাই ওপার বাংলার ক্রিকেট ও রাজনীতির বেশ ভালোই খবর রাখেন। আগের রাতে দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে টাইগারদের বাজে হারে তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি। সূত্র : মানবজমিন
টেস্টের পর টি-টোয়েন্টি’র প্রথম দুটি ম্যাচে নাজমুল হোসেন শান্তরা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি। কী কারণ এর নেপথ্যে! দলের ক্রিকেটাররা দেশের উইকেট নিয়ে অভিযোগ করলেও শুভ জ্যোতি এটি মানতে নারাজ। আড্ডা দিতে দিতে জানালেন এমন হারের পেছনে তার ভাবনার কথা-‘আমার মনে হয় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ যখন খেলতে নামে তখন একটি মেন্টাল ব্লক তাদের মধ্যে কাজ করে। মনে আছে ২০১৬তে বেঙ্গালুরুতে মাহমুদুল্লাহ-মুশফিক জেতা ম্যাচটি কীভাবে দলকে হারিয়ে দিলো! আসলে দু’টি জিনিস হয় একটি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারে না আরেকটি হলো জেতার মতো অবস্থাতে এসে হেরে যায়।’
ভারতে আসার আগে পাকিস্তানকে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ দল তাদেরই মাটিতে। যে কারণে সবার বিশ্বাস ছিল ভারতে হয়তো জিততে না পারলেও কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবে টাইগাররা। কিন্তু চেন্নাইয়ে প্রথম টেস্ট সাড়ে তিনদিনে হার! আর কানপুরে বৃষ্টিতে ৩ দিন ভেসে যায়। কিন্তু শেষ দুই দিনেই ভারত ব্যাটিং-বোলিংয়ে রেকর্ড গড়ে জিতে যায়। গোয়ালিয়রে প্রথম টি- টোয়েন্টিতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি। দিল্লিতে এসে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু সেই ম্যাচে বড় রানের ব্যবধানে হার! এমন হারের জন্য যতটা টাইগারদের স্কিলের দায় তারচেয়ে বেশি মানসিক দুর্বলতা।
কারণটাও ব্যাখ্যা করলেন বিবিসি’র বিশেষ প্রতিনিধি। শুভ জ্যোতি বলেন, ‘আশা করেছিলাম পাকিস্তানে যেভাবে খেলেছে সেটির একটি ধারাবাহিকতা রাখবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা আগের মতোই চাপ নিতে ব্যর্থ। আমার কাছে মনে হয় ভারত দলে যে বড় বড় নামগুলো প্রভাব ফেলে বাংলাদেশের ওপর। আমি ২০০৫ থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ফলো করি। যখন ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ সিরিজ খেলতে গিয়েছিল। আমার মনে আছে সেটি মুশফিকের প্রথম সিরিজ, একেবারেই বাচ্চা ছেলে। সেখানে আশরাফুল বেশ ভালো খেলেছিল। যাই হোক, তখন থেকেই দেখছি ভারত সামনে এলেই তাদের মধ্যে একটা ‘মাইন্ড ব্লক’ কাজ করে।
নার্ভের ওপর চাপ ফেলে। জিতেছে কয়েকবার এটাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক ক্লোজ ম্যাচ বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে হেরেছে। টেস্ট, টি-টোয়েন্টি এই দুটি ফরম্যাটে বাংলাদেশ যে ভারতকে হারাতে পারে তারা সেই বিশ্বাসটাও খুঁজে পায় না। তারা এমন করে যে জিতে থাকা ম্যাচেও তারা হঠাৎ করে সব এলোমেলো করে ফেলে। কিন্তু দেখেন একই সময় অন্য দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স কিন্তু এমন নয়। তারা দারুণ খেলে।’
২০১৯, দিল্লির আকাশে ঘন ধোঁয়াশা। বায়ুদূষণ বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে। ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হবে কি হবে না তা নিয়ে শঙ্কা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলতে মাঠে জিতে দিল্লির দিল জিতে নেয় বাংলাদেশ। সেবারই প্রথম আমন্ত্রণে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে এসেছিল টাইগাররা। অবশ্য পরের টানা দুই টি- টোয়েন্টি টানা হার ও টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ। ঠিক পাঁচ বছর পর এসে একই পরিণতি। দিল্লি জয়ের যে সুখস্মৃতি ছিল সেটি এবারের বাজে হারের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল। এমন পারফরম্যান্সের নেপথ্যে বড় কারণ জানালেন শুভ জ্যোতি।
তার মতে, ‘এটাতে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই যে ভারত অনেক অনেক ভালো দল। ক্রিকেটের সব ফরম্যাটেই ভারত অনেক এগিয়ে। তাদের শত বছরের ক্রিকেট খেলার ইতিহাস। আর বাংলাদেশ তো সেই হিসাব করলে শুরু করলো মাত্র। এখানে দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ সবার একটি আলাদা ক্রিকেট কালচার আছে। আর গেল ১০/১২ বছরে আইপিএল ভারতের ক্রিকেটকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যে কারণে টেস্টেও তারা টি- টোয়েন্টির মতো খেলতে পারে। কানপুরই তো তার প্রমাণ বাংলাদেশ কল্পনাও করতে পারেনি এমন একটি বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচ শেষ দুইদিনে ভারত জিতে যাবে।’
‘সাকিব-মাহমুদুল্লাহদের বিদায় বাস্তবতা’
টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারের পরও ভারতে বাংলাদেশ দল দু’টি কারণে বেশ আলোচনায়। কানপুরে হঠাৎ করেই দুই ফরম্যাট থেকে অবসরে ঘোষণা দেন সাকিব আল হাসান। এরপর দিল্লিতে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ জানিয়ে দেন তিনিও আর টি-টোয়েন্টি খেলবেন না। ভেবেচিন্তে অবসর নিয়েছেন। এই দুই ঘোষণাতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শেষ হয়ে গেল টাইগার পঞ্চপাণ্ডবের ইতিহাস। এর আগে মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল, মুশফিক এই ফরম্যাট ছেড়েছেন। কেউ কেউ এটিকে দলের জন্য আশীর্বাদ মনে করেন। তবে শুভ জ্যোতির কাছে এটি বাস্তবতা। তার মতে, ‘ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে এমন বড় বড় ক্রিকেটাররা একটা সময় বিদায় নিয়েছেন। বাংলাদেশের পঞ্চপাণ্ডব বলে যারা পরিচিত তাদের আর টি- টোয়েন্টিতে দেখা যাবে না। এমনকী ধীরে ধীরে তারা অন্য কোনো ফরম্যাটেও থাকবেন না। এটি আসলে আশীর্বাদও না আবার দলের জন্য বড় কোনো ক্ষতি বা অভিশাপও না। আমি মনে করি এটাই বাস্তবতা, তাদের চলে যেতে হবে, গেছেন। এখন নতুনরা সেখানে জায়গা করে নেবে। এখন দেখার বিষয় যে, বেঞ্চটা আছে সেখানে তাদের অভাব পূরণ করার মতো কেউ আছে কিনা। যদি থাকে ভালো নয়তো বেশ কিছু দিন স্ট্রাগল করতে হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :