পার্সটুডে- শুধু মাতৃভূমি লেবানন নয়, ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার পবিত্র সংগ্রামে যার অবদান ইতিহাস কখনোই ভুলবে না তিনি হলেন সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ। লেবানন ও ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের এই অনন্য নেতা গত শুক্রবার বৈরুতের দাহিয়া এলাকায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের বর্বর হামলায় শহীদ হয়েছেন।
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ লেবাননের হিজবুল্লাহর তৃতীয় মহাসচিব। ১৯৮২ সালে হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৯২ সালে ইহুদিবাদী ইসরাইল হিজবুল্লাহর দ্বিতীয় মহাসচিব সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভিকে শহীদ করার পর দলের হাল ধরেন সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ।
সাইয়্যেদ হাসান নাসরাল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়। নাসরুল্লাহর নেতৃত্বাধীন হিজবুল্লাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে বহু সফল অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হয়, এর ফলে ২০০০ সালে ইসরাইলি বাহিনী লেবানন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এই সংগ্রামীকে একজন মহান মুজাহিদ, নেতা এবং প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
পার্সটুডে'র এই নিবন্ধে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর জীবনী তুলে ধরা হচ্ছে:
জীবন, জন্ম এবং পরিবার
লেবানন তথা গোটা বিশ্বের পরিচিত মুখ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৬০ সালের ৩১ আগস্ট পূর্ব বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার বাবা সাইয়্যেদ আব্দুল করিম এবং মা নাহদিয়া সাফিউদ্দিন ছিলেন দক্ষিণ লেবাননের সুর শহরের বাজুরিয়েহ গ্রামের বাসিন্দা। পরবর্তীতে তারা বৈরুতে বসবাস শুরু করেন।
প্রতিরোধের নেতা ১৯৭৫ সালে পরিবারের সঙ্গে নিজেদের গ্রামে ফিরে যান এবং সুর শহরের উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৬ বছর বয়সে সুর শহরের জুমার নামাজের ইমাম সাইয়্যেদ মোহাম্মদ গারাভি এবং প্রখ্যাত ইরাকি চিন্তাবিদ ও আইনশাস্ত্রবিদ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ বাকের সাদ্রের বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহ ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের জন্য ইরাকের নাজাফে যান। শহীদ সাদ্রের কাছে একটি চিঠি লিখে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর শহীদ আয়াতুল্লাহ সাদ্র এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেন এবং সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর লেখাপড়াসহ বিভিন্ন দিক দেখভাল করার দায়িত্ব পান শহীদ সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভি।
১৯৭৮ সালে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ নাজাফে ধর্মীয় বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং ইরাকের বাথ সরকারের চাপের কারণে দুই বছর পরই লেবাননের উদ্দেশ্যে নাজাফ ত্যাগ করেন। লেবাননের বালবেকে 'ইমাম মুন্তাযার ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি সেখানে ধর্মীয় পড়ালেখা চালিয়ে যান। একইসঙ্গে সেখানে তিনি শিক্ষকতাও করতেন। সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৭৮ সালে ১৮ বছর বয়সে ফাতিমা ইয়াসিনের সাথে বিয়ে করেন। তাদের ঘর উজ্জ্বল করে জন্ম নেয় চার ছেলে ও এক মেয়ে। তাদের প্রথম সন্তানের নাম সাইয়্যেদ হাদি। ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ লেবাননে দখলদার ইসরাইলি সেনাদের সাথে সংঘর্ষের সময় সাইয়্যেদ হাদি শহীদ হন। সে সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর।
সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ তার যৌবনের প্রথম থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রবেশ করেন। ইরান থেকে লেবাননে যাওয়া প্রখ্যাত আলেম ও চিন্তাবিদ ইমাম মুসা সাদ্রের প্রতি ভক্তির কারণে তিনি তার আন্দোলনে যোগ দেন। ইমাম মুসা সাদ্র লেবাননের শিয়াদের সুপ্রিম অ্যাসেম্বলি এবং আমাল আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বিভিন্ন ধর্ম ও মাজহাবের মধ্যে ঐক্য ও সহাবস্থান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইমাম মুসা সাদ্র বড় ভূমিকা রাখেন। সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ তার ভাই সাইয়্যেদ হোসেনকে নিয়ে তাদের গ্রামে আমাল আন্দোলনের নেতৃত্বে দেন। আমাল আন্দোলন লেবাননের জনগণকে রক্ষায় এবং দখলদার ইসরাইলকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য গঠিত হয়েছিল।
১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরাইলি হামলার পর একদল সংগ্রামী আলেমের পাশাপাশি সাইয়্যেদ হাসান নাসরাল্লাহও আমাল মুভমেন্ট থেকে আলাদা হয়ে যান এবং আরও সক্রিয় সংগ্রামের লক্ষ্যে তারা ইসরাইলবিরোধী ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহকে শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হিজবুল্লাহর কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে থাকার পাশাপাশি তিনি লেবাননে ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদারিত্ব মোকাবেলায় প্রতিরোধ বাহিনী গঠন এবং বিভিন্ন সামরিক ইউনিট প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পারন করেন। কিছু দিন বৈরুতে হিজবুল্লাহর প্রধান ইব্রাহিম আমিন আল সাঈদের ডেপুটি হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি হিজবুল্লাহর নির্বাহী উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মহাসচিবের দায়িত্ব
দখলদার ইসরাইল হিজবুল্লাহর দ্বিতীয় মহাসচিব সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভিকে শহীদ করার পর ১৯৯২ সালে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ সংগঠনের কেন্দ্রীয় পরিষদের মাধ্যমে মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। মহাসচিবের দায়িত্ব পালনকালে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন এই মহান সংগ্রামী। তার নেতৃত্বে লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে নানা বিজয়ের পাশাপাশি তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও বড় বিজয় পায়। ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবাননকে ইসরাইলের কাছ থেকে দখলমুক্ত করা, ২০০৬ সালে ৩৩ দিনের যুদ্ধে অভাবনীয় বিজয় এবং ইরাক ও সিরিয়ায় অবৈধ আইএস সরকারের পতন মহাসচিব নাসরুল্লাহর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সাফল্য।
আইএস-কে পরাজিত করার ক্ষেত্রে সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহকে ব্যাপক সহযোগিতা দিয়েছেন ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি'র কুদস ফোর্সের কমান্ডার শহীদ কাসেম সোলাইমানি। এসব কারণে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে প্রতিরোধের সাইয়্যেদ বলা হয়।
প্রতিরোধ সংগ্রামের অনন্য কৌশল এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে বারবার বিজয়ের কারণে হাসান নাসরুল্লাহর আরব ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
ব্যর্থ গুপ্তহত্যা
দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইল এর আগে কয়েক বার সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
খাদ্যে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যাচেষ্টা (২০০৪)
আবাসস্থল লক্ষ্য করে ইসরাইলি বিমানের সাহায্যে বোমা হামলা (২০০৬)
অবস্থানস্থল মনে করে সেখানে ইসরাইলি বিমান হামলা (২০১১)
অবশেষে শুক্রবার রাতে বৈরুতে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সন্ত্রাসী বিমান হামলায় মহান এই সংগ্রামী নেতা শাহাদাৎবরণ করেন।
আপনার মতামত লিখুন :