জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের পঞ্চম শীর্ষ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগর এবং তিন দিকে ভারত দিয়ে ঘেরা ব-দ্বীপটি ইতিহাসের এক জটিল সন্ধিক্ষণ পার করছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের নজিরবিহীন কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে। যে অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমায় এবং যেভাবে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তারও নজির নেই। তবে গত মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে ইসলামি চরমপন্থা বিস্তারের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি তুরিন আফরোজের বাড়িতে ঢুকে পড়েন একদল তরুণ। তাঁরা তুরিনের শয়নকক্ষে ঢুকে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং হিজাব না পরায় হম্বিতম্বি করেন। একপর্যায়ে তাঁরা তুরিনের মাথার চুল কেটে দেন। ওই তরুণেরা তুরিন আফরোজকে কয়েক দিন জিম্মি করে রাখেন এবং তাঁকে পেনসিল দিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করেন। তাঁকে ইসলাম বিষয়ে ‘শিক্ষা’ দেন। সূত্র : আজকের পত্রিকার প্রতিবেদন প্রথম পর্ব
তাঁদের দ্বারা তাঁর কিশোরী মেয়ে আক্রান্ত হতে পারে ভেবে তুরিন উদ্বিগ্ন ছিলেন। মেয়ে ধর্ষণের শিকার হতে পারে বলেও তাঁর মনে আশঙ্কা তৈরি হয়। গণমাধ্যমকে তুরিন বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, তাঁরা হয়তো আমাকে হত্যা করবে। আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম।’
জনসংখ্যার দিক থেকে পঞ্চম শীর্ষ মুসলিম দেশ বাংলাদেশ ইতিহাসের জটিল সন্ধিক্ষণে রয়েছে। পশ্চিমা দেশ ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, চরমপন্থীরা বিশ্বের অস্থির অঞ্চলটিতে পা রাখার দ্বারপ্রান্তে, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামিক স্টেটের মতো সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক প্রসার লাভ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক উত্তেজনা, ইসরায়েলের সঙ্গে লেবানন ও হামাসের যুদ্ধ চরমপন্থীদের দলভুক্ত করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী ১৫ বছরের শাসনের অবসান আশা জাগিয়েছে যে, বাংলাদেশ হয়তো নতুন যুগে প্রবেশ করে গণতান্ত্রিক ও পরিচ্ছন্ন সরকার পেতে যাচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তক, হিলারি ক্লিনটনের বন্ধু এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে সমর্থন দিয়ে সেনাবাহিনী সেই আশাকে আরও পোক্ত করেছে।
তবে শেখ হাসিনার পতনের প্রায় অর্ধশতক বছর আগে সংঘটিত গণহত্যা থেকে উদ্ভূত চরমপন্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। শেখ হাসিনা তাঁর শাসনামলে চরমপন্থীদের কঠোরভাবে দমন করেছেন, যার প্রশংসা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা। ভারতে পালিয়ে যায় অন্তত ১ কোটি মানুষ। তাঁদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। ১৯৭১ সালে গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তাই ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর বিচারের মাধ্যমে বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড দেন তিনি।
কিন্তু পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসানের পর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাঁর সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা বেড়েছে। ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা শিথিল রয়েছে, দূতাবাসগুলো স্বল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে কাজ করছে, ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে কিশোরেরা সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং বহু থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হাজার হাজার হিন্দু এরই মধ্যে তিব্বত ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ভারতের স্পর্শকাতর এলাকায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সেসব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহীদের আনাগোনা আছে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গবেষক পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, ‘এ ধরনের বিপ্লবোত্তর পরিবেশ অবিশ্বাস্য রকম নাজুক। ফলে চরম অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে ইসলামী চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মাথাচাড়া দেওয়ার ঝুঁকি আছে।’
সেনাবাহিনী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন চাইলেও বাংলাদেশে এখন ঠিক কী ঘটবে তা স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এরই মধ্যে বিপদের মুখে পড়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভর বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের জরুরি সহায়তা চায়।
দীর্ঘদিনের কারফিউ, মহাসড়কে ব্যাপক বিক্ষোভের ফলে বাংলাদেশে জারা, গ্যাপ এবং এইচএন্ডএমের মতো ফাস্ট-ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। রপ্তানিকারকেরা আশঙ্কা করেছেন, চলতি বছর এসব ব্র্যান্ডের বিক্রি ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অনেক ব্র্যান্ড পরের মৌসুমের তৈরি পোশাকের জন্য অন্য কোথাও উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।
এমন প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ছে। প্রায় এক দশক আগে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত চরমপন্থীরা ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের ওপর লাগাতার ছুরি হামলা চালায়। ২০১৬ সালে ইসলামী পরমপন্থীদের একটি দল গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে জিম্মি করে নির্বিচার গুলি চালায়। তখন এক ডজনেরও বেশি বিদেশিকে হত্যা করা হয়। ব্যাপক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এর জবাব দেয় হাসিনা সরকার।
হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর মুখোশধারীরা হিন্দু মন্দিরে আগুন দিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী অধ্যাপকদের পর্দা করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি প্রচারিত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ভেঙে ফেলে ইসলামী চরমপন্থী একটি গোষ্ঠীর পোস্টার টানানো হয়েছে।
সেনাবাহিনীর সমর্থনে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা ড. ইউনূসের হাতে দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব তুলে দেয়। দরিদ্রদের নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির জন্য হাসিনা ড. ইউনূসকে প্রকাশ্যে ‘রক্তচোষা’ বলেছেন বছরের পর বছর। তাঁর আমলে ড. ইউনূসকে অর্থ পাচার ও ঘুষের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দেওয়া হয়। কিন্তু ড. ইউনূস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারে পতনের আগে সংঘটিত রক্তপাতের নিন্দা করেছেন ড. ইউনূস। অল্প সময়ের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন তিনি। কিন্তু স্বাধীনতার পর অর্ধশতকে দুই ডজনেরও বেশি সামরিক অভ্যুত্থানের এই দেশে জীবন-মৃত্যুর রাজনীতির আনুষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। তাঁর ১৯ উপদেষ্টার সবাই মূলত শিক্ষাবিদ, অ্যাকটিভিস্ট ও ছাত্র। তারা কেউই হাসিনার মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারী নন।
হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘ইউনূসের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ বা যথেষ্ট ক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না।’ তিনি বলেন, সরকারের পতনের পর থেকে ইসলামপন্থী ও সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে আন্দোলনকে ব্যবহার করেছে।
আপনার মতামত লিখুন :