শিরোনাম
◈  কয়েক দফায় মূল্য বৃদ্ধি: ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে চাল ◈ ব্যাংক খাত ঝুঁকির মুখে: খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি ৫ ব্যাংকে ◈ জামানত ছাড়াই  ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন ◈ সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করায় তাজকীরকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেন অভি ◈ খাদ্য সহায়তা হ্রাস, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন কি রোহিঙ্গাদের অন্ধকার ভবিষ্যতে নিয়ে যাবে! ◈ বাংলাদেশ নিয়ে তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য বিভ্রান্তিকর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ◈ ভুল চিকিৎসায় যুবকের মৃত্যু, ৪ লাখ টাকায় রফাদফা, চুক্তিপত্র ভাইরাল ◈ বাণিজ্য উপদেষ্টার প্রশংসা করে যা বললেন হাসনাত ◈ গাজীপুরে শ্রমিক নিহতের জেরে মহাসড়ক অবরোধ, পুলিশের ৬ সদস্য আহত ◈ বিশ্বকাপ বাছাই, ব্রজিলের বিরুদ্ধে মেসিকে ছাড়াই  দল ঘোষণা আর্জেন্টিনার

প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট, ২০২৪, ০৬:০৯ বিকাল
আপডেট : ১৪ মার্চ, ২০২৫, ০৭:০০ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শেখ হাসিনার ওপর চাপ কমাতে, পশ্চিমাদের কাছে ভারতের ‘ধর্না', ওয়াশিংটন পোস্ট

রাশিদ রিয়াজঃ ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রয়োগ বন্ধ করতে পশ্চিমা দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছিল ভারত। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছর আগে, ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছে লবিং শুরু করেন। 

বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকায়, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ ইস্যুতে শিথিলতা প্রদর্শন করার জন্য চাপ দিয়েছিল ভারত। বৃহস্পতিবার মার্কিন ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে এই তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সমালোচকদের কারাগারে পাঠানোর ঘটনার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন মার্কিন কূটনীতিকরা। বিচারবহির্ভূত অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে শেখ হাসিনার প্রশাসনের একটি পুলিশ ইউনিটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল বাইডেন প্রশাসন। পাশাপাশি, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বা গণতন্ত্র ক্ষুণ্নকারী বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল ওয়াশিংটন।

এই পরিস্থিতির পর ভারতীয় কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রপন্থী বিবৃতি কমানোর দাবি জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তি দেন, যদি বিরোধী দলকে উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশ ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি হয়ে উঠতে পারে, যেখানে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারত সরকারের একজন উপদেষ্টা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, 'আপনি এটাকে গণতন্ত্রের মানদণ্ডে বিচার করতে পারেন, কিন্তু আমাদের জন্য এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমেরিকানদের সাথে আমাদের অনেকবার কথা হয়েছে, যেখানে আমরা বলেছি, এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। কৌশলগত ঐক্যমতের অভাবে আপনি আমাদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে নিতে পারবেন না।'

শেষ পর্যন্ত, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ ইস্যুতে সমালোচনা কমিয়ে আনে এবং শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে পরবর্তী নিষেধাজ্ঞার হুমকি স্থগিত করে, যা বাংলাদেশে অনেকের জন্য হতাশাজনক ছিল। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, এটি ছিল একটি নিষ্পত্তিমূলক সিদ্ধান্ত, যার সঙ্গে ভারতীয় চাপের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। মার্কিন ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার বিষয়গুলো এতদিন প্রকাশ হয়নি।

গত ৫ আগস্ট, যখন বিক্ষোভকারীরা সেনাবাহিনীর কারফিউ অমান্য করে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করে, তখন শেখ হাসিনা ভারতে পালাতে বাধ্য হন। এই ঘটনার পর ভারত ও ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করেছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

মার্কিন এক কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেন, বলেন, 'বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবসময় ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। কারণ, এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে পরিস্থিতি জটিল, এবং আপনি অংশীদারদের সাথে এমনভাবে কাজ করতে চান, যা আমেরিকান জনগণের প্রত্যাশার সাথে পুরোপুরি মেলে না।'

গত জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে মার্কিন সরকারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় যে, কীভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হবে। তৎকালীন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ দূতাবাস ও পররাষ্ট্র দপ্তরের অন্যান্য কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেন। তবে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেছিলেন, শেখ হাসিনাকে বিচ্ছিন্ন করে খুব একটা লাভ হবে না।

ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নেতিবাচক দিকটি হোয়াইট হাউজের কিছু কর্মকর্তারাও বিবেচনায় রেখেছিলেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বারবার আবেদন করেছিলেন যেন শেখ হাসিনার ওপর চাপ কমিয়ে দেওয়া হয়। গত বছর নভেম্বরে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নয়াদিল্লিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সাথে বৈঠক করেন, যেখানে এই বিষয়টি আলোচিত হয়। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও ওয়াশিংটন সফরকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মার্কিন এক কর্মকর্তা বলেন, 'বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় উভয় দেশের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আমরা অনেকবার প্রকাশ্যে সেসব বিষয়ে কথা বলেছি। কিন্তু আমরা বাস্তবতাও উপলব্ধি করি, কারণ বাংলাদেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং সেখানে অনেকের স্বার্থ রয়েছে। আমাদেরও স্বার্থ আছে এবং অন্যান্য দেশগুলোরও স্বার্থ রয়েছে।'

ভারতের জন্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি শেখ হাসিনার দশকব্যাপী রাজনৈতিক বাজির বিষয়টি তুলে ধরেছে। এমনকি শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী ও অজনপ্রিয় হয়ে ওঠার পরও তার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার কারণে ভারত বেকায়দায় পড়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর হস্তক্ষেপকারী ও কট্টর জাতীয়তাবাদী দেশ হিসেবে দেখা হয়।

জানুয়ারিতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কারাগারে পাঠিয়ে কিংবা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করে শেখ হাসিনা নির্বাচন আয়োজন করেন, যেখানে একতরফাভাবে তার দল জয় লাভের দাবি করে। ভারতীয় কর্মকর্তারা এই নির্বাচনের ফলাফলে সমর্থন দেন, যা বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। আর মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের প্রভাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জন ড্যানিলোভিজ মন্তব্য করেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে এই অঞ্চলে নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার ওপর লাগাম টানার প্রবণতায় রয়েছে। তবে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা করা ভুল ছিল।'

তিনি বলেন, 'নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনকে এখন কিছু নমনীয়তা দেখাতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে যে, তারা বাংলাদেশের জনগণ ও তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পাশে না থেকে ভুল করেছে।'

তবে মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতীয় প্রভাবের সমালোচনা করেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সহিংসতা হ্রাস ও অবাধ নির্বাচনের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিতর্কিত নির্বাচনের পরও তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশিদের ওপর আরও বিধিনিষেধ আরোপ না করায় কেউ কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছিলেন।

বিক্ষোভের ফলে শত শত প্রাণহানির পর, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে তাদের কৌশল পরিবর্তন করেন এবং জানান যে, তারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসা যে কারও সাথে কাজ করবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে অভিনন্দন জানান। এর আগে ইউনূস শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন জানানোয় ভারতের সমালোচনা করেছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

একজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, ভারত পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করেছিল যে, বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে দেশটি নতুন একটি আফগানিস্তানে পরিণত হতে পারে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেন, শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের শাসনামলে ইসলামপন্থী জঙ্গিরা ভারতীয় ভূখণ্ডে আক্রমণ করার জন্য অস্ত্র পাচার করেছিল। এই অভিজ্ঞতা ভারতকে শেখ হাসিনার প্রতি অনড় সমর্থন দিতে প্রভাবিত করেছে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় আসতে পারে বলে তারা উদ্বিগ্ন। হিন্দুদের ওপর হামলা বৃদ্ধির খবরও ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপির নেতারা জানান, তারা ভারতের সাথে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দুরা নিরাপদ থাকবে।

ভারত হঠাৎ করে তার ঘনিষ্ঠ মিত্রকে হারানোর ধাক্কা সামাল দিতে চেষ্টা করছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে জল্পনা-কল্পনা চলছে যে, ওয়াশিংটন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেছিল। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা এই দাবিকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। 

নয়াদিল্লির অন্যান্য কর্মকর্তারা বলছেন, এতদিন ধরে একজন কর্তৃত্ববাদী শাসককে সমর্থন করার জন্য ভারত দায়ী। ভারতের একজন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, 'ঢাকা থেকে আসা প্রতিবেদনগুলোতে প্রায়ই বলা হতো যে, ভারত-বিরোধী মনোভাব নজিরবিহীন পর্যায়ে রয়েছে। তবুও আমরা ধরে নিয়েছিলাম, শেখ হাসিনা সবকিছু সামলে নেবেন। কিন্তু পুরো ঘটনাটি, একটি স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করেছিল, যা পুরো পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়