ইকবাল খান: [২] ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি শেষ পর্যন্ত এককভাবে পেয়েছে ২৪০টি আসন। সরকার গড়ার জন্য পার্লামেন্টে দরকার অন্তত ২৭২টি আসন, সুতরাং বিজেপির আসন সংখ্যা তার চেয়ে ঠিক ৩২টি কম। সূত্র: বিবিসি
[৩] যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সরকার গড়তে হলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে এখন জোটসঙ্গী দলগুলোর সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। যদি প্রাক-নির্বাচনি জোটসঙ্গীরা কোনও কারণে জোট ছেড়ে যায়, বিজেপিকে হয়তো নতুন সঙ্গী দলও খুঁজতে হতে পারে।
[৪] সবচেয়ে বড় কথা, গত এক দশক ধরে বিজেপির একার শক্তিতেই বলীয়ান একটি ক্ষমতাবান সরকার চালানোর পর নরেন্দ্র মোদিকে এখন একটি তুলনামূলকভাবে দুর্বল কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিতে হবে। এতদিন শরিক দলগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরোয়া না-করলেও এখন সরকারকে টিঁকিয়ে রাখার স্বার্থেই তাকে সঙ্গীদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
[৫] এই প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কিছু উত্তর খোঁজা হয়েছে এই প্রশ্নটিরই!
[৬] ব্যর্থতার উত্তর উত্তরপ্রদেশে?: ভারতের রাজনৈতিক ভূগোলটা ভাল করে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, নির্বাচনি ল্যান্ডস্কেপে উত্তরপ্রদেশই হল গোটা দেশে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য।
[৭] দেশে যে কোনও রাজ্যের চেয়ে বেশি ৮০ টা লোকসভা আসন দেয় বলেই সম্ভবত, অতীতেও দেখা গেছে যে দল বা জোট উত্তরপ্রদেশে জিততে ব্যর্থ হয়েছে তাদের দিল্লির ক্ষমতায় আসাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[৮] কিন্তু গত দুটো নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে যথাক্রমে ৭২টি ও ৬৩টি আসন পাওয়ার পর ওই রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা এবার ৩৩-এ নেমে এসেছে, যে ফলাফল দলের নেতা-কর্মীরা কেউ আশাই করেননি।
[৯] উত্তরপ্রদেশের পরে সবচেয়ে বেশি লোকসভা আসন যে দু’টি রাজ্যে, সেই মহারাষ্ট্র (৪৮) ও পশ্চিমবঙ্গও (৪২) বিজেপিকে দারুণভাবে নিরাশ করেছে। মহারাষ্ট্রে গতবারের তুলনায় তাদের আসন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে, আর পশ্চিমবঙ্গে আসন কমেছে এক-তৃতীয়াংশ।
[১০] এছাড়া হিন্দি হার্টল্যান্ড বা গোবলয়ের আরও দু’টো রাজ্য, রাজস্থান ও হরিয়ানাতে এবং দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকেও বিজেপি প্রচুর আসন হারিয়েছে।
[১১] সেই জায়গায় উড়িষ্যা, তেলেঙ্গানা বা অন্ধ্রের মতো নতুন নতুন রাজ্যে বিজেপি ভাল সাফল্য পেলেও তা কিন্তু এই ‘ঘাটতি’টা পুষিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ছিল না।
[১২] বস্তুত এখন দেখা যাচ্ছে, গতবারের তুলনায় শুধু উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যে ৩০-টার মতো আসন খুইয়েছে, সেটা ধরে রাখতে পারলেই তারা কিন্তু এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি পৌঁছে যেত।
[১৩] তবে আপাতত ম্যাজিক নাম্বারে পৌঁছতে বিজেপির ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ চিহ্নিত করতে হলে আঙুল তুলতে হবে উত্তরপ্রদেশের দিকেই!
[১৪] ‘ইট’স দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’: ১৯৯২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিল ক্লিন্টন যখন ক্ষমতাসীন জর্জ ডাব্লিউ বুশের (সিনিয়র) বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জার হিসেবে দাঁড়ান, তখন প্রচারে কোন কোন বিষয়ে জোর দিতে হবে তার নির্বাচনি স্ট্র্যাটেজিস্টরা তার একটা নকশা তৈরি করেছিলেন।
[১৫] সেই পটভূমিতেই সামনে এসেছিল ‘ইট’স দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’ - এই বাক্যবন্ধটি! আসলে অর্থনীতি যে বিশ্বের যে কোনও নির্বাচনেরই সারকথা, এটা পন্ডিতরা বহুকাল ধরেই বলে আসছেন। এই চারটি শব্দ খুব কম কথায় সেই বার্তাকেই সার্থকভাবে প্রতিফলিত করেছে।
[১৬] গত এক দশকে ভারতের অর্থনীতি একেবারে বেহাল দশায় পৌঁছেছে, তা মোটেই বলা যাবে না কিন্তু এই অর্থনীতির নানা বিরূপ অভিঘাত কিন্তু নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজেপিকেও যথেষ্ঠ ভুগতে হয়েছে।
[১৭] কোভিড মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মতো নানা আন্তর্জাতিক প্রভাবের জেরেই হোক বা নানা অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যবৃদ্ধির চাপে ভারতের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষজন হিমশিম খাচ্ছেন তাতে কোনও ভুল নেই।
[১৮] রান্নার জ্বালানি গ্যাসই হোক বা চাল-ডাল-আটা-তরিতরকারির মতো রোজকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সব জিনিসের অগ্নিমূল্যে দেশের আমজনতা নাভিশ্বাস ফেলছেন। আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি (ইনফ্লেশন) পরিস্থিতিকে আরও অসহনীয় করেছে।
[১৯] বিশ্লেষকদের মতে ভারতের সাম্প্রতিক অর্থনীতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটা মূলত ‘জবলেস গ্রোথ’ যার মানে শতকরা হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও তাতে কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে চাকরি বা কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বহু বিশেষজ্ঞই সরকারকে এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন।
[২০] যেমন এই মুহুর্তে ভারতে বেকারত্বের হার সরকারি হিসেবেই ৮.১ শতাংশ যা প্রায় সর্বকালীন রেকর্ডের কাছাকাছি। সারা দেশে এই চাকরির হাহাকার বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে কর্মসংস্থানের অভাব দেশের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই বিজেপিকে ভুগিয়েছে।
[২১] বিরোধী দলগুলোও প্রায় নিয়ম করে প্রতিটি নির্বাচনি সভায় এই চাকরির অভাব বা ‘বেরোজগারি’র ইস্যু তুলেছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তো তার প্রায় প্রতিটি ভাষণই শুরু করতেন এই প্রসঙ্গ দিয়ে।
[২২] এছাড়া বছরকয়েক আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ভর্তির জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার ‘অগ্নিবীর’ নামে যে বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করে সেটাও ভারতের বহু রাজ্যে যুবকদের মধ্যে প্রবল হতাশা সৃষ্টি করে।
[২৩] ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পের জন্য ভারতীয় সেনাতে একজন জওয়ান হিসেবে ‘পাকা চাকরি’তে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ অনেক সঙ্কুচিত হয়ে আসে এখন বেশির ভাগ আর্মি রিক্রুটই কেবল পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন।
[২৪] ভারতের বহু রাজ্য, বিশেষত যেখানে বড় শিল্পের অভাব আছে – সেখানে তরুণদের জন্য চাকরির বড় ভরসা ছিল এই ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেই সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তরুণরা অনেকেই হয়তো বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।
[২৫] ‘চারশো পার’-এর ব্যাকফায়ার?: বছরের শুরুতে যখন ভারতে ভোটের দামামা ভাল করে বাজেইনি, তখনই প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আবকি বার, চারশো পার!’
[২৬] বিজেপি তথা এনডিএ জোটের জন্য চারশোরও বেশি আসনে জেতার সেই টার্গেট বেঁধে দেওয়া দলের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছিল কি না, ড্রয়িং বোর্ডে ফিরে গিয়ে বিজেপির নীতি-নির্ধারকদেরও এখন সে কথা ভাবতে হবে।
[২৫] প্রধানমন্ত্রী ‘চারশো পার’ স্লোগান দেওয়ার পর থেকেই বিরোধী নেতারা ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে আসছিলেন, এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ‘ব্রুট মেজরিটি’ নিয়ে নরেন্দ্র মোদী আসলে কী করতে চান? তার উদ্দেশ্যটা কী?
[২৬] এরই মধ্যে কর্নাটকে বিজেপি-র তখনকার এক এমপি বলে বসেন, ‘চারশো পার’ আসন পেলে তাহলেই দল প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধন করতে পারবে এবং হিন্দুরাষ্ট্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সফলভাবে এগোতে পারবে। দলকে অস্বস্তিতে ফেলা সেই নেতাকে বিজেপি সাসপেন্ড করতেও বাধ্য হয়।
[২৭] প্রসঙ্গত, ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা জরুরি। লোকসভার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ৩৬১ বা তার কাছাকাছি।
[২৮] তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত মানুষজন ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির (ওবিসি) জন্য ভারতে সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় যে ‘সংরক্ষণ’ চালু আছে বিজেপি সংবিধান সংশোধন করে সেই অধিকার কেড়ে নিতে চায় কি না, সেই প্রশ্নও তখন থেকেই উঠতে থাকে।
[২৯] নির্বাচনি প্রচারের সময়ও দেখা গেছে, নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে শীর্ষ বিজেপি নেতারা একের পর এক জনসভায় গিয়ে রক্ষণাত্মক সুরে সাফাই দিচ্ছেন, গরিব মানুষের ‘কোটা’ বা সংরক্ষণ কেড়ে নেওয়ার কোনও অভিপ্রায় তাদের নেই! কিন্তু ততদিনে যা বার্তা যাওয়ার চলে গিয়েছে।
[৩০] নরেন্দ্র মোদি আর একটা কথাও বারবার বলেছেন – তফসিলিদের সংরক্ষণ বহাল রাখলেও তিনি দেশে ‘ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ’ কিছুতেই হতে দেবেন না, কারণ ভারতীয় সংবিধানের রূপকাররা এটির অনুমতি দেননি।
[৩১] স্বভাবতই এই কথার অর্থ করা হয়েছে, বিজেপি সরকার মুসলিমদের সংরক্ষণের আওতায় কখনওই আনবে না।
[৩২] তা ছাড়া বিশেষ করে দ্বিতীয় দফার ভোটের পর থেকে নরেন্দ্র মোদি নিজে যেভাবে তার ভাষণে কখনও ‘মঙ্গলসূত্র’ বা কখনও ‘মুজরা’-র প্রসঙ্গ টেনে, কখনও বা ‘যাদের বেশি বাচ্চাকাচ্চা হয়’ বলে বিশেষ একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করেছেন – সেটাও কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে ভারতের মুসলিম ভোটকে ‘কনসলিডেট’ বা সংহত করেছে।
[৩৩] ২০১৯ সালের নির্বাচনের পরও বিজেপি নেতারা গর্ব করে বলতেন, মোদিজি দেশের মুসলিমদেরও একটা বড় অংশের ভোট পান কারণ তা না-হলে এতগুলো কেন্দ্রে এত বড় ব্যবধানে জেতাই সম্ভব নয়।
[৩৪] ‘পসমিন্দা’ বা পশ্চাতপদ মুসলিম গোষ্ঠীগুলো বা ভারতের মুসলিম নারীদের কাছে টানার জন্য দল বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে অনেক উদ্যোগও নিয়েছিল।
[৩৫] এবারে কিন্তু ফলাফলের প্রাথমিক গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, ভারতের দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণি এবং মুসলিমদেরও অনেকেই বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :