ডেস্ক রিপোর্ট : গত এক সপ্তাহ ধরে বগা লেকের পানি ঘোলা হয়ে আছে। বগা লেকের পানি হঠাৎ করে ঘোলা হয়ে যাওয়ার কারণ এখনও অজানা। কয়েক বছর পর পর ঠিক কী কারণে পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত লেকের স্বচ্ছ পানি ঘোলা হয়ে যায়, তা সবার কাছে আজও এক রহস্য।
ঘোলা হয়ে যাওয়ায় স্থানীয়রা এখন আর বগা লেকের পানি ব্যবহার করতে পারছেন না। লেকের পাশের পাড়ার বাসিন্দা ময় বম বলেন, “গত ২৭ জানুয়ারি থেকে লেকের পানি ঘোলা হতে শুরু করে। লেকের শেওলা পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।”
বাংলাদেশের অনেক ভূতাত্ত্বিক বগা লেককে মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করলেও, বগা লেককে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মধ্যে নানা কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। এই লেককে ঘিরে বসবাসকারী বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘খোয়াইতে ঙামতন’ গূঢ় অর্থপূর্ণ কাহিনীই সবচেয়ে সমাদৃত। রাইংক্ষ্যং লেকের পাড়ের বাসিন্দা যতীন্দ্র ত্রিপুরা জানান, রাইংক্ষ্যং লেকের পানিও পাঁচদিন ধরে ঘোলা হয়ে আছে।
প্রবীণ রিয়ালদো বম জানান, বগালেকের পানি ঘোলা হলে রাইংক্ষ্যং লেকের পানিও একইসঙ্গে ঘোলা হয়। অথচ এই দুই লেকের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। বগা লেকের গভীরে দানবাকৃতির সাপ আছে বলে আজও বিশ্বাস করেন রিয়ালদো বমের মতো অনেক পাহাড়ি।
‘খোয়াইতে ঙামতন’ পৌরাণিক কাহিনী :
অনেক বছর আগে এক লোকের দুষ্ট প্রকৃতির চার ছেলে ছিলো। চার ছেলেই বাবা-মায়ের খুব অবাধ্য ছিলো এবং পাড়ার লোকদের উৎপাত করতো। এদিকে বাবার বকুনিতে জুমে গেলেও চার ভাই জুম খেতে অলস সময় পার করতো। কয়েক বছর পর পঞ্চম ছেলে জন্মগ্রহণ করলে বাবা-মা খুব খুশি হয়ে ছেলের নাম রাখেন ‘খোয়াইতে ঙামতন’। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে খোয়াইতে ঙামতন অনেক সাহসী পুরুষ হয়ে উঠলো। একদিন পাহাড় থেকে বিশাল এক সাপ নেমে আসলে পাঁচ ভাই মিলে সেটিকে বধ করলো।
ছোট ভাইকে সাপটি রান্নার দায়িত্ব দিয়ে বড় ভাইরা জুম খেতে চলে গেলো। খোয়াইতে ঙামতন সাপের মাংস খুব যত্নসহকারে রান্না করছিলো। এমন সময়ে পাহাড় থেকে আরেকটি বিরাট সাপ এসে চুলায় রান্না করা মাংসটি ফেলে দিলো। সাপটি তার মুখ থেকে একটি শেকড়ের টুকরো বের করে রান্না করা মাংসের ওপর ছোঁয়ালে ধীরে ধীরে সেটি প্রাণ ফিরে পায়। এরপর শেকড়টি রেখে সাপ দুটি পাহাড়ে ফিরে গেলো। শেকড়টি নিজের কাছে রেখে খোয়াইতে ঙামতন আড়ালে এই রহস্যময় ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো।
চার ভাই জুম থেকে ফিরে মাংস না পেয়ে ছোট ভাইয়ের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে সজোরে আঘাত করতে লাগলো। খোয়াইতে ঙামতন রহস্যময় ঘটনাটি বারবার বলার চেষ্টা করলেও কেউ তাকে বিশ্বাস করলো না। চার ভাইয়ের আঘাতে খোয়াইতে ঙামতনের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়লে মারা গেছে মনে করে তারা তাকে জঙ্গলে ফেলে আসলো। কিছুক্ষণ পর কোমরে লুকিয়ে রাখা ওই শেকড় খণ্ড ছুঁয়ে আসা বাতাস লাগলে খোয়াইতে ঙামতনের জ্ঞান ফিরে আসে।
জ্ঞান ফেরার পর বড় ভাইদের নিষ্ঠুর নিপীড়নের কথা স্মরণ করে খোয়াইতে ঙামতন সংকল্প করলো এমন নির্দয় ভাইয়ের কাছে আর ফিরে যাবে না। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করতে করতে রহস্যময় শেকড়ের কথা তার মনে পড়লো। “খণ্ড খণ্ড মাংস জোড়া লেগে গেলো, আমার জ্ঞান ফিরে আসলো, এই শিকড় খণ্ডের রহস্য কী?” এরকম প্রশ্ন তার মনে তৈরি হলে। এর প্রকৃত গুণ যাচাই করার জন্য তার মন কৌতূহলী হয়ে উঠলো।
খোয়াইতে ঙামতন ছোটবেলা থেকেই গুলতি ছোড়া এবং শর নিক্ষেপে নিপুণ ছিলো। অজানার উদ্দেশে পথ চলতে চলতে দুর পাহাড়ের পাড়ার উঁচু গাছের ডালে একটি ঘুঘু পাখি দেখতে পেয়ে সে সেটিকে লক্ষ্য করে গুলতি ছুড়লো। মৃত পাখিটির গায়ে শেকড় খণ্ডের ছোঁয়া দিলে সেটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলো। কিছুদূর পথ অতিক্রম করার পর রাস্তায় পরে থাকা একটি মৃত কুকুর এবং একটি মৃত কাককে শেকড়ের ছোঁয়া দিয়ে সুস্থ করে তুললে তারা খোয়াইতে ঙামতন এর বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠলো। এভাবে তারা গহীন অরণ্য, পাহাড়, ছড়া ও উপত্যকায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
একদিন দূর পাহাড়ের কোল থেকে মেয়েদের কান্না শুনতে পেলে খোয়াইতে ঙামতন এবং তার তিন সহচর সেখানে ছুটে গেলো আর জানতে পারলো রাজ্যরে এক রাজকুমারী মারা গেছে। খোয়াইতে ঙামতন সে নগরে প্রবেশ করে এক বিধবার বাড়িতে উঠলো। বিধবার মুখ থেকে রাজকন্যার মৃত্যুর ইতিবৃত্ত শুনে বললো, “মহারাজের অনুগ্রহ হলে আমি রাজকুমারীকে সুস্থ করে তুলবো। আমাকে রাজপুরীতে নিয়ে চলুন।”
বিধবা খোয়াইতে ঙামতনকে রাজপুরীতে নিয়ে আসলে রাজকুমারীর শয্যার চারিদিকে বিমর্ষচিত্তে থাকা রাজ্যের সবার সঙ্গে রাজাকেও দেখা গেলো। খোয়াইতে ঙামতন রাজপুরীতে প্রবেশ করা মাত্র রাজ্যাধিপতি জিজ্ঞাসা করলেন, “হে যুবক, কে তুমি, কি বা তোমার নাম?” যুবক উত্তর দিলো, “আমি ভবঘুরে এক পথযাত্রী, নাম খোয়াইতে ঙামতন। পাহাড় পর্বত ঘুরে ঘুরে আপনার রাজ্য সীমানায় প্রবেশ করা মাত্র কান্না আর আহাজারি শুনতে পেয়ে চলে এসেছি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি রাজকুমারীকে সুস্থ করে তুলবো।”
রাজ্যাধিপতি সিংহাসন ত্যাগ করে খোয়াইতে ঙামতনের কাছে এসে বললেন, “হে যুবক, এ আমার প্রাণাধিক প্রিয় কন্যা, তাকে সুস্থ করে তুলতে পারলে তার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো, এ আমার প্রতিজ্ঞা। খোয়াইতে ঙামতন সকলকে অন্তঃপুর হতে চলে যেতে অনুরোধ করে গৃহের সকল বাতায়ন খুলে দিয়ে কোমরের শেকড় খণ্ডটি রাজকুমারীর শয্যার পাশে রাখলে ধীরে ধীরে তার দেহে প্রাণ সঞ্চার হলো।
মহা ধুমধামে খোয়াইতে ঙামতনের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে সম্পন্ন হলো। কিন্তু খোয়াইতে ঙামতনের সুখের দিন বেশি দিন স্থায়ী হলো না। স্বামীকে প্রতিনিয়ত বনের বিভিন্ন প্রাণীর মাংস আনার জন্য পীড়া দিতো তার স্ত্রী। খোয়াইতে ঙামতন নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দুর্গম পর্বত থেকে তার স্ত্রীর জন্য শিকার নিয়ে আসতো।
“আমার জন্য বিশালাকার বন্য শূকর- যার গায়ের লোম রিপুয়াল (এক প্রকার কাঁটাযুক্ত বেত) চেয়েও শক্ত, শান দেওয়া দীর্ঘ তলোয়ারের মত তীক্ষ্ণ দাঁত, নয় মুঠা (শূকরের আকার মাপার মুঠি হিসাব) দাঁতাল শূকরের কলিজা এনে দাও, তা না হলে আমার প্রাণ বায়ু চলে যাবে” বলে খোয়াইতে ঙামতনকে তার স্ত্রী অস্থির করে তুললে- একদিন শিকারের উদ্দেশ্যে সপ্ত পাহাড় পার করে গহীন বনে পর্বতসম বিশাল শূকরটিকে হত্যা করলেও, হঠাৎ খোয়াইতে ঙামতনের বৃদ্ধ আঙ্গুল শূকরটির দাঁতে আটকে গিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এতে সে ইহজগৎ ত্যাগ করে।
খোয়াইতে ঙামতনের মৃত্যুর খবর শুনে পার্বত্য জনপদের লোকজন সাত দিন ধরে শোক পালন করেন। অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী নগরের এক কোণায় বিধবার লাকড়ি ঘরেই খোয়াইতে ঙামতনকে সমাহিত করা হলো। খোয়াইতে ঙামতনের মৃত্যুর পর মাস অতিবাহিত না হতেই গবাদি পশুশূন্য হয়ে গেলো গোটা রাজ্য। প্রতি রাতেই একটি করে শিশুও হারিয়ে যেতে লাগলো। সারা রাজ্য বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো।
একদিন রাজা সারা পাহাড়ের ঝোপঝাড়, লতা-গুল্ম পরিচ্ছন্ন করার আদেশ দিলেন। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার সময় এক বৃদ্ধ পাহাড়ের এক প্রান্তে বড় এক গর্তে বিরাট এক সাপ দেখতে পেয়ে পাড়ার লোকদের সেখানে জড়ো করলো। তাদের ধারণা এই সাপই হলো খাদক। তারা গর্তের মুখে একটি ছাগলের বাচ্চা ঝুলিয়ে বৃহৎ এক বড়শী দিয়ে ফাঁদ পাতলো। পরের দিন ভোরে এলাকাবাসী দেখলো বড়শীতে সাপটি আটকে আছে। সবাই মিলে সাপটিকে গর্ত থেকে টেনে বের করতে লাগলো। অনেকক্ষণ টানার পর হঠাৎ সাপটি বলে উঠলো, “আমার লেজের অগ্রভাগ অতল গভীরে লাকড়ির ঘরের খুঁটিতে প্যাঁচানো”। এলাকার লোকদের আর ধৈর্য ধরলো না। তারা কুঠার দিয়া সাপটিকে কেটে ফেললো। অতল গভীর গর্তে সাপটির অবশিষ্টাংশের পতনের শব্দ মেঘের গর্জনের মতো শোনা গেলো। এক বিধবা ছাড়া সাপটির মাংসের ভাগ রাজ্যের সবাই পেলো।
দয়াপরবশ: হয়ে বিধবাকে সাপটির মাথা দেওয়া হলো। বিধবা সাপটির মাথা রান্না করতে গেলে হঠাৎ মাথাটি কথা বলে উঠলো। বললো, “নানী, লবণ দিও না”। মরিচ দিতে গেলে বলে, “মরিচ দিও না”।
বিধবা ভয়ে রান্নার পাত্রটি ঘরের বাইরে রেখে আসলে গভীর রাতে সেটি আবার বলতে লাগলো, “নানী গো, ভোরের মোরগ ডাকার আগেই তোমার গৃহের অতিথিদের বিদায় দিও। প্রলয় হবে, মহাপ্রলয়।”
খুব ভোরে বিধবার ঘর থেকে অতিথিরা বিদায় নিলেন। অতিথিরা যেই মাত্র নগররাজ্যের সীমানা ছাড়লেন, অমনি প্রলয় শুরু হলো। চারিদিকে বজ্রনিনাদ, বিশাল রাজ্যনগর নিমিষিইে নিমজ্জিত হলো। শুধু নগরের এক প্রান্তে বিধবার ভিটেঘরটিই ডুবলো না। চারিদিকে পানি এসে বিশাল দীঘি সৃষ্টি হলো। আজ এই দীঘিই বগা লেক নামে পরিচিত। (প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন জির কুং সাহু, জুয়ামলিয়ান আমলাই, রিয়ালদো বম, ময় বম)
সুত্র : ডেইলি স্টার
আপনার মতামত লিখুন :