বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের বৈঠকের কথা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পরে জানতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
রোববার (২৩ মার্চ) রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'সেনাবাহিনী এবং হাসনাত ও সারজিসের মধ্যে বৈঠকের কথা পরে জানতে পারে এনসিপি। সেই বৈঠকটি নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে হয়নি।'
এনসিপি প্রধান সমন্বয়ক (উত্তর) সারজিস আলম আজ সকালে এক ফেসবুক পোস্টে এনসিপি প্রধান সমন্বয়ক (দক্ষিণ) হাসনাত আব্দুল্লাহর ১১ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে করা মন্তব্যের সঙ্গে 'দ্বিমত' প্রকাশ করেছিলেন।
এর আগে, গত শুক্রবার (২১ মার্চ) হাসনাত আব্দুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেন, ১১ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে এক বৈঠকে আসন সমঝোতা ও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি লেখেন: ' কিছুদিন আগে আমি আপনাদের বলেছিলাম যে, "রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ" নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের।'
তবে সারজিস তার পোস্টে দাবি করেন যে, " রিফাইন্ড " বিষয়ে যে কথা বলা হয়েছিল তা সেনাবাহিনী প্রধানের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব ছিল না, বরং এটি ছিল একটি মতামত।
সারজিস তার পোস্টে লেখেন, ''মানুষ হিসেবে যেকোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির অভিমতকে একেকজন একেকভাবে অবজার্ভ করে। হাসনাত সেদিন তার জায়গা থেকে যেভাবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে অবজার্ভ ও রিসিভ করেছে এবং ফেসবুকে লিখেছে আমার সেক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিমত আছে। আমার জায়গা থেকে আমি সেদিনের বক্তব্যকে সরাসরি 'প্রস্তাব' দেয়ার আঙ্গিকে দেখিনা বরং 'সরাসরি অভিমত প্রকাশের' মতো করে দেখি। 'অভিমত প্রকাশ' এবং 'প্রস্তাব দেওয়া' দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যদিও পূর্বের তুলনায় সেদিন সেনাপ্রধান অনেকটা স্ট্রেইথ-ফরোয়ার্ড ভাষায় কথা বলছিলেন।
তিনি আরও লেখেন, পাশাপাশি 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের জন্য 'চাপ দেওয়ার' যে বিষয়টি এসেছে সেখানে 'চাপ দেওয়া হয়েছে' এমনটি আমার মনে হয়নি। বরং রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ না আসলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে সেটা তিনি অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছিলেন।''
তাদের বক্তব্যের বিষয়ে নাসীরুদ্দীন বলেন, 'অপরপক্ষের কনসেন্ট ছাড়াই এ ধরনের মন্তব্য অনভিপ্রেত। সেই বৈঠকটি নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে হয়নি। মিটিংটি হওয়ার পর আমাদেরকে জানানো হলেও সেটি নিয়ে এখনও দলীয় আলোচনা হয়নি। রোববার রাতে আলোচনা শেষে পার্টির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অফিসিয়ালি জানানো হবে।'
দলের নেতাদের ভুলগুলি ক্ষমাশীল মনোভাবের সাথে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি দাবি করেন, 'তবে এতে নাগরিক কমিটির মধ্যে কোনো বিভেদ বা বিভাজন তৈরি হয়নি। এনসিপি নেতাদের মধ্যে কোনো ভুল বুঝাবুঝি ও দূরত্ব নেই।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আন্দোলন ও রাজনীতি আলাদা জায়গা। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররা আন্দোলন থেকে রাজনীতিতে প্রবেশ করছেন। তাই এই সময়ের ভুলগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।'
মানুষের প্রত্যাশা এনসিপির প্রতি অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তাদের সে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করে যাব।'
এদিকে নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাসদরের এক বিবৃতিতে সেনানিবাসে খোদ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে ১১ মার্চ বৈঠকটি হওয়ার কথা স্বীকার করা হলেও হাসনাত আব্দুল্লাহকে 'ডেকে নিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে তাদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগে'র অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বরং হাসনাত আব্দুল্লাহ ও এনসিপির আরেক মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের আগ্রহেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদেরকে পাঠানো বিবৃতিতে সেনাসদর নিশ্চিত করেছে যে ওই বৈঠকটি সেনাপ্রধানের সঙ্গেই হয়েছিল; তবে ছাত্রনেতাদের বৈঠকটি আগ্রহেই হয়েছিল বলে তাতে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হাসনাত আব্দুল্লাহর পোস্টকে 'সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বই অন্য কিছু নয়' বলেও মন্তব্য করা হয়েছে সেনাসদরের বিবৃতিতে। এছাড়া এই ছাত্রনেতার বক্তব্যকে 'অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ক গল্পের সম্ভার' হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে সেনাবাহিনী।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সারজিস আলম দীর্ঘদিন যাবৎ সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য ইচ্ছা পোষণ করছিলেন। পরবর্তীতে সারজিস আলম ১১ই মার্চ ২০২৫ তারিখে সেনাপ্রধানের মিলিটারি এডভাইজারকে ফোন দিয়ে সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাতের জন্য সময় চান। এর প্রেক্ষিতে মিলিটারি এডভাইজার তাদেরকে সেনাসদরে আসার জন্য বলেন।"
"অতঃপর ১১ই মার্চ দুপুরে সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনাসদরে না এসে সরাসরি সেনাভবনে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেন। পরবর্তীতে সেনাপ্রধান অফিস কার্যক্রম শেষ করে সেনা ভবনে এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।"
নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে আলোচনা হওয়ার বিষয়টি সেনাসদরের বক্তব্যে অস্বীকার করা হয়নি। সেখানে বলা হয়, আলোচনায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গ উঠে এলে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নিজের অভিমতের কথা ছাত্রনেতাদের জানান।
বিবৃতিতে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, 'আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা ফৌজদারি মামলায় জড়িত নয় ও ক্লিন ইমেজের অধিকারী তাদের সমন্বয়ে নতুন আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, ফলপ্রসু ও আন্তর্জাতিক মহলে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার ও সব রাজনৈতিক দল মিলে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।'
আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গে দেয়া বক্তব্য সেনাপ্রধানের নিজস্ব অভিমত হিসেবে আখ্যা দিয়ে ছাত্রনেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ বিবৃতিতে অস্বীকার করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি কোনোক্রমেই তাদেরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে তাদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগ করার ঘটনা নয়।' উৎস: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।