এল আর বাদল : বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার তিন মাসের মাথায় ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই ছিল অন্য কোনো দেশের সরকার প্রধানের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর।
ব্যাপক আয়োজনে তখন মিসেস গান্ধীকে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল। তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে স্বপরিবারে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ঘোষণা করা হয়েছিল একদিনের সরকারি ছুটি।
তিন দিনের সফরকালে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিব একটি চুক্তি সই করেন, ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ স্বাক্ষরিত ওই চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি’ নামে পরিচিত। সূত্র, বিবিসি বাংলা
২৫ বছর মেয়াদী এই চুক্তিটি ঘিরে তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক জন্ম নিতে দেখা গিয়েছিল। বিরোধীরা একে ‘গোলামী চুক্তি’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু কী ছিল সেই চুক্তিতে? কেনই-বা চুক্তিটিকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল? এই প্রতিবেদনে সেসবই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
চুক্তির প্রেক্ষাপট
১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধী যখন ঢাকার মাটিতে পা রাখেন, তার ঠিক এক বছর আগে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে এক সেনা অভিযানের মাধ্যমে এখানে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার। ২৫শে মার্চের ওই হত্যাযজ্ঞের পর স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলাদেশ। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। তাদের ভারতের মাটিতে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র জোগাড়েও সহায়তা করে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার।
এমনকি, এক পর্যায়ে ভারত নিজেও সেই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানি সৈন্যরা। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ইন্দিরা গান্ধী যেভাবে পাশে ছিলেন, স্বাধীনতা অর্জন করার পর অনেকটা সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই তাকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানান শেখ মুজিবুর রহমান।
আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ ঢাকা আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেদিন সকাল সাড়ে দশটার দিকে তাকে বহনকারী ‘রাজহংস’ নামের বিশেষ উড়োজাহাজটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ঢাকায় পা রাখার পর শেখ মুজিব নিজে উপস্থিত থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাগত জানান। মিসেস গান্ধীর সম্মানে সেদিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়। ওইদিন অবশ্য শেখ মুজিবের জন্মদিনও ছিল। ফলে ছুটির কারণ নিয়ে অনেকের মধ্যেই এক ধরনের বিভ্রান্তি কাজ করছিল।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারপ্রধান নিজের ভাষণে স্পষ্ট করে দেন যে, ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা আগমন উপলক্ষ্যে। ভবিষ্যতে তাঁহার জন্মদিন আর সরকারী ছুটির দিন হিসাবে উদযাপিত হইবে না। এই দিনটি কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের দিন হিসাবে পালিত হইবে, শেখ মুজিবের বক্তব্যের বরাত দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ খবর প্রকাশ হয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রথম পাতায়।
নৈশভোজে ভাষণ
তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে চড়ে সরাসরি বঙ্গভবনে যান ইন্দিরা গান্ধী। সফরের তিনদিন সেখানেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
সেসময় বঙ্গভবনে বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব তালুকদার, জীবদ্দশায় যিনি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কমিশনারও হয়েছিলেন। বঙ্গভবনে পাঁচ বছর নামের গ্রন্থে মি. তালুকদার উল্লেখ করেছেন যে, মিসেস গান্ধীর আগমন উপলক্ষ্যে সেদিন বঙ্গভবনকে বিশেষ সাজে সজ্জিত করা হয়েছিল।
অভ্যন্তরীণ সাজ-সজ্জার জন্য কলকাতা থেকে মিসেস বসন্ত চৌধুরীকে কমিশন করে আনা হয়েছিল। বসন্ত চৌধুরী স্বনামখ্যাত চিত্রনায়ক ও নাট্যাভিনেতা। তার স্ত্রী স্বনামখ্যাত ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর। ভদ্রমহিলা দিন রাত পরিশ্রম করে বঙ্গভবনকে সাজিয়ে দিলেন, লিখেছেন মি. তালুকদার। সফরের প্রথমদিন বিকেলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি জনসভায় অংশ নেন মিজ গান্ধী।
জনসভা উপলক্ষ্যে মাঠটির এক পাশে নৌকার আকারে বিশাল একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। মাহবুব তালুকদার তার গ্রন্থে লিখেছেন যে, মঞ্চটির নাম দেয়া হয় ‘ইন্দিরা মঞ্চ’।
সফরের দ্বিতীয় দিন নাগরিক সংবর্ধনার পাশাপাশি বঙ্গভবনে আয়োজিত নৈশভোজেও অংশ নেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরাজমান বন্ধুত্বমূলক পরিবেশকে দূষিত করার জন্য ভিতরের ও বাহিরের বিরুদ্ধ মহল চেষ্টা করিবে।
তার এই বক্তব্য তুলে ধরে ইত্তেফাক পত্রিকায় পরদিন এটাও লেখা হয়, “কিন্তু তিনি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেন যে, উভয় দেশের মৈত্রী সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে অধিকতর শক্তিশালী ও সফল হইবে।
মৈত্রী চুক্তি সই
ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ২৫ বছর মেয়াদী একটি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সফরের তৃতীয় দিনে চুক্তিটিতে নিজ নিজ দেশের পক্ষে সই করেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী।
যদিও সফরকালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালনকারী মিসেস গান্ধীর চিফ অব প্রোটোকল বা রাষ্ট্রাচার বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা ফারুক চৌধুরীর ভাষ্য, মৈত্রী চুক্তি সই হয়েছিল ১৮ই মার্চ, অর্থাৎ সফরের দ্বিতীয় দিনে।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে মি. চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর সফরের দ্বিতীয় দিন শীতলক্ষ্যা নদীতে এক নৌবিহারে। চুক্তিটি সই হয়েছিল স্থলে নয়, জলে,” বলেছিলেন মি. চৌধুরী।
তবে ১৯শে মার্চ তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মুজিব-ইন্দিরা সফল আলোচনা’ শিরোনামের খবর থেকে জানা যায় যে, ১৮ই মার্চ শীতলক্ষ্যার নৌবিহারটি হয়েছিল ঠিকই, তবে সেই নৌবিহারে শুধু দুই নেতার মধ্যে চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আর চুক্তি সই হয়েছিল মিসেস গান্ধীর সফরের শেষ দিন, অর্থাৎ ১৯শে মার্চ।
দৈনিক ইত্তেফাক ২০শে মার্চ তাদের প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম লেখে, বন্ধুত্ব সহযোগিতা শান্তি এবং তাতে পত্রিকাটি উল্লেখ করে - ইন্দিরা গান্ধীর সফর শেষে ঢাকা ত্যাগের আগে বঙ্গভবনে দুই নেতা ১২ দফাবিশিষ্ট চুক্তিটিতে সই করেন।
কী ছিল চুক্তিতে?
‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি’ নামে পরিচিত ওই চুক্তিটিতে মোট ১২টি ধারা রাখা হয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল যে, দুই দেশ একে অন্যের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তার বিষয়ে সম্মান প্রদর্শন করবে এবং কেউই একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। কোনো পক্ষ স্বাক্ষরকারী অপর পক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনো সামরিক জোটে অংশ নেবে না।
পরস্পর পরস্পরের প্রতি কোনো আক্রমণ করবে না এবং অপর পক্ষের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে এমন কোনো কাজে নিজের ভূমি ব্যবহার করতে দেবে না। এছাড়া শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক আরও ধারা ছিল চুক্তিতে। দুই দেশের মধ্যে শিক্ষা, খেলাধুলা, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহায়তার উল্লেখও ছিল চুক্তিতে। গবেষকদের মতে, চুক্তিটি করা হয়েছিল অনেকটা ১৯৭১ সালের ভারত-সোভিয়েত চুক্তির আদলে।
কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে দুটি চুক্তিই ছিল হুবহু এক। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তিটির মেয়াদ ছিল ২০ বছর, আর বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিটির মেয়াদ ২৫ বছর।
২০১১ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফারুক চৌধুরী বলেন, এই চুক্তির মধ্যে নতুন কোনো ‘এলিমেন্ট’ ছিল না।
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে চুক্তিটি হয়েছিল ওইটারই একটা অনুলিপি ছিল এটা, বলেছিলেন মি. চৌধুরী।
তবে মি. চৌধুরীর চোখে চুক্তিটি ছিল তৎকালীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা এবং সার্বভৈামত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার একটি বিশেষ পদক্ষেপ।আমরা ভেবেছি আমাদের নিরাপত্তা বাড়বে এতে। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের উদ্দেশ্য কী তা তো আমরা জানি না। কী হবে না হবে! অতএব একটা দেশের সাথে একটা সমতার ভিত্তিতে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে আমরা আরো পাকাপোক্ত করলাম,” বিবিসি’র সাক্ষাৎকারে বলেন মি. চৌধুরী।
সেসময় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন অরুন্ধতী ঘোষ। তার চোখে এই চুক্তিটি ছিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী বিষয়’।
২০১১ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমার যেটা মনে হয়, আমাদের যে নতুন বন্ধুত্বটা গড়ার দরকার ছিল সেটাকে একটা প্রুফ দেয়া, যে আমাদের এই বন্ধুত্বটা থাকবে।
অবশ্য এই চুক্তিটি ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফরের সময়ে হলেও চুক্তির ব্যাপারে ঐকমত্য তার আগের মাসে শেখ মুজিব তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে যখন ভারত গিয়েছিলেন, তখনই হয়ে গিয়েছিল বলে কয়েকজন ইতিহাসবিদের বিবরণে উঠে আসে।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে প্রথম সরকারি সফরে শেখ মুজিবুর রহমান দু’দিনের সফরে কলকাতা গিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে।
তার সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি থেকে কলকাতা উড়ে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এসময় কলকাতার রাজভবনে দুজনের যে সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেখানেই মিসেস গান্ধীকে ফিরতি সফরের দাওয়াত দিয়েছিলেন শেখ মুজিব।
একই সফরে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহারের ব্যাপারেও জোর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। ফারুক চৌধুরী তার জীবনীগ্রন্থ ‘জীবনের বালুকাবেলায়’ লিখেছেন, মাত্র দুই দিনের অবস্থানের মধ্যেও কলকাতায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে ছিলেন সক্রিয়।
শেখ মুজিবের সেই সফরের দ্বিতীয় দিনে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার পর যুক্ত ইশতেহারে ঘোষণা করা হয় যে, ‘২৫শে মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সমাপ্ত করা হবে’। তবে বাস্তবে এই সৈন্য প্রত্যাহার শেষ হয়েছিল তারও দু’সপ্তাহ আগে।
‘গোলামী চুক্তি’
ফারুক চৌধুরীর ভাষায়, চুক্তিটি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো ‘দ্বিমত’ ছিল না। কিন্তু চুক্তিটি হয়ে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে এর তুমুল সমালোচনা তৈরি হয়। কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও তাদের মুখপত্র বলে পরিচিত দৈনিক পত্রিকাগুলো এই চুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সমালোচনায় যোগ দেয়।
সেগুলোর মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ‘হক কথা’, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী সম্পাদিত ‘দেশবাংলা’, জাসদের মুখপত্র হিসেবে নতুন প্রকাশিত ‘দৈনিক গণকণ্ঠের’ মতো পত্রিকাও ছিল।
পত্রিকাগুলোর খবরে, ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিকে ‘গোলামী চুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান তখন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ করতেন।
২০২২ সালের এক সাক্ষাৎকারে মি. খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, তখন সমালোচনার পয়েন্ট ছিল একটাই। এই চুক্তি হওয়া মানে বাংলাদেশটাকে শেখ মুজিব ভারতের হাতে লিজ দিয়ে দিয়েছেন।
তখনকার বিরোধী “পার্টিগুলো ক্রমাগত কিন্তু মুজিববিরোধী এবং চুক্তিবিরোধী কথাবার্তা বলেছে এবং সেটাকে বলেছে গোলামী চুক্তি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর এই অবস্থান ছিল স্রেফ ‘বিরোধিতার কারণে’, এমন মত লেখক ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষক মহিউদ্দীন আহমদের।
ইন্দিরা-মুজিব মৈত্রী চুক্তিটি ছিল ১৯৭১ সালের অগাস্ট মাসে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির হুবহু প্রতিরূপ, কিন্তু এটা নিয়ে ভারতে কোনো বিরোধিতা হয়নি উল্লেখ করে মি. আহমদ বলেন, “আমাদের এখানে হয়েছে, কারণ আমাদের এখানে সরকার যেটাই করবে কিছু লোক তার বিরোধিতা করবে, সবসময়ই”।
তবে এ নিয়ে তখন কোনো রাজনৈতিক দল হরতাল ডেকেছে বলেও মনে করতে পারেন না সেসময়ের গণকণ্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক মি. আহমদ, যদিও সেসময় রাজনৈতিক দলগুলো মি. আহমদের ভাষায় কথায় কথায় হরতাল ডাকতো।
কিন্তু যারা বিরোধিতা করেছে, এটা বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করেছে। তারা যখন ক্ষমতায় গেছে তারা এই চুক্তি বাতিল করে নাই,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমদ।
ফারুক চৌধুরীর চোখে এটি ছিল একটি ‘হার্মলেস’ (নির্বিষ) কিন্তু ‘প্রয়োজনীয়’ চুক্তি। কিন্তু ১৯৯৭ সালের যে পৃথিবী সেটা ১৯৭২ সাল থেকে কমপ্লিটলি (সম্পূর্ণরূপে) ভিন্ন ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই। রাশিয়া হয়ে গেছে। টাইম মেড ইট ইররেলেভেন্ট (সময় এটাকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে)। এই চুক্তির মৃত্যু তো দেখেছি। একটা হচ্ছে এটার তো কোনো প্রয়োজন নেই। লেট ইট ডাই এ ন্যাচারাল ডেথ (এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে দেয়া হোক), ২০১১ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন মি. চৌধুরী।
যারা আশঙ্কা করেছিলেন যে চুক্তি নবায়ন হবে, তাদের আশঙ্কা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমি মনে করি সেটা সময়ের প্রয়োজনে হয়েছিল। সেটা সে সময়ে আমাদের সাহস যুগিয়েছিল। শক্তি দিয়েছিল । আমাদের সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় করেছিল। এটার মনস্তাত্ত্বিক একটা সিগনিফিকেন্স (গুরুত্ব) ছিল”, বলেছিলেন মি. চৌধুরী।
কতটা কাজে লেগেছিল?
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি কতটা কার্যকর হয়েছে বা আদৌ কাজে লেগেছিল কি-না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, কোনোপক্ষই চুক্তির শর্তগুলো কাজে লাগানোর জন্য অনুরোধ করেনি বা বাস্তবায়নের দিকে যায়নি, বিবিসি বাংলাকে বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
২০১৫ সালে প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থ ‘বিপুলা পৃথিবী’তে ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, যত সমালোচনা হয়েছিল, চুক্তি তার সামান্য ভাগও কার্যকর হয়নি।
আর এই কার্যকর না হওয়ার পেছনে ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনও একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি অরুন্ধতী ঘোষ।
শেখ সাহেব মারা যাওয়ার পরে কিছুদিন অনেকগুলো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং (ভুল বোঝাবুঝি) এসেছিল, ২০১১ সালে বিবিসিকে বলেছিলেন মিজ ঘোষ। তিনি বলেন, চুক্তির উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি বলে আমি মনে করি।
আমি যতদিন ছিলাম বন্ধুত্বটা গড়ছিল। কিন্তু অনেকগুলো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং-ও (ভুল বোঝাবুঝি) শুরু হয়েছিল আমাদের সাইড (পক্ষ) থেকে, বিবিসিকে বলেছিলেন মিজ ঘোষ। ১৯৯৭ সালের ১৯শে মার্চ যখন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারপরও ভারত কিংবা বাংলাদেশ কেউই এই চুক্তি আর নবায়নে আগ্রহ দেখায়নি।