মহসিন কবির: আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট দল গেচাচ্ছে নতুন ছাত্রদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দল ও জোট নিয়ে দলটির নেতারা বিভিন্ন হিসাব-নিকেশ করছেন।
আগামী নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জিততে যাচ্ছে বলে মনে করেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এনসিপি প্রধান বলেছেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস— এবারের নির্বাচনে আমরা জয়ী হবো। তবে এই নির্বাচনই শেষ নয়... আমাদের লক্ষ্য আরও ৫০, ১০০ বা তারও বেশি বছর ধরে এই শক্তি ধরে রাখা।’
এএফপিকে তিনি বলেন, হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে এখনো সমস্যার মুখে পড়ছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই নির্বাচন বিলম্বের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয়। তবে এটা সত্যি নয়।’
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দিকেই জোর দিতে চাচ্ছেে এনসিপি। এরই মধ্যে দলটি নির্বাচনে এককভাবে নাকি জোটবদ্ধ হয়ে অংশ নেবে তা নিয়েই বেশ আলোচনা চলছে। দেশের সর্ববৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে তৃতীয় দল হিসেবে নির্বাচনী মাঠে নামতে পারে এনসিপি। দলটির নেতারা মনে করেন ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে এনসিপির। তবে তৃণমূল শক্তিশালী না হলে বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোট করতে পারে দলটি। এ ক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে জোটের আগ্রহ নেই বেশিরভাগ নেতাকর্মীর। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দলটি।
২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক পার্টি ইতিমধ্যেই দুই দফায় ২১৬ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে। তবে এই কমিটি আরও বর্ধিত করা হবে। তাছাড়া, জাতীয় নাগরিক কমিটির ৪৩০-এর অধিক জেলা-উপজেলা কমিটি বিদ্যমান রয়েছে। কমিটিগুলো এনসিপির কমিটি হিসেবেই কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা জুলাই স্পিরিটকে ধারণ করে কেউ যোগ দিতে চাইলে তাদের অগ্রাধিকার দেবে তারা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পরে দেশে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের পর দেশের বৃহত্তর দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে আঞ্চলিক নির্বাচনের দাবি জানালেও বিএনপি আগেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এরই মধ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনাকে পতনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারা নেতৃত্বে আসার পরেই নির্বাচনী মাঠে নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে।
শুরুতে ইফতার কর্মসূচির মতো ছোট কর্মসূচি গ্রহণ, দলের তৃণমূল গোছানো, জেলা উপজেলা কমিটির বাস্তবায়নই এনসিপির নেতাদের মূল লক্ষ্য। ইতিমধ্যেই আগামী ১০ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জুলাই ও আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের সদস্যসহ সব অংশীজনদের নিয়ে এবং ১১ মার্চ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিলের কর্মসূচি দিয়েছে দলটি। দ্রুত সময়ের মধ্যে দলটি নিজেদের তৃণমূল গোছাতে পারলে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে বা বৃহত্তর দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ‘বাজিমাত’ করতে পারে বলেও আশাবাদী দলটির নেতারা।
সূত্রমতে, দলটি নিজেদের কেন্দ্রে রেখে অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে পারে। তবে বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গেও জোটের কথা ভাবছেন এনসিপির অনেকেই। যদিও জামায়াতের সঙ্গে জোট করতে তেমন একটা আগ্রহী নয় এনসিপি বলে জানা যায়।
এনসিপির এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য একটি গণপরিষদ নির্বাচন। আমরা সম্ভব হলে এককভাবেই ভোটে যেতে চাই। তবে যদি জোটের প্রয়োজন হয় আমরা জোটবদ্ধ হতে পারব। সেক্ষেত্রে বিএনপি জামায়াতের প্রশ্ন আসে। আমাদের অধিকাংশই জামায়াতের সঙ্গে জোট করতে আগ্রহী না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এনসিপির। আপাতত দলটি মনোযোগী হচ্ছে জনসমর্থন আদায়ে। দেশব্যাপী মানুষের দুর্ভোগ কমানো, শান্তি নিশ্চিত ও মানুষের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। দিচ্ছে ওপর মহল। দল গুছিয়ে আনতে পারলে এবং মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে পারলে আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে যাচ্ছে দলটি।
এনসিপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, দল এখন গোছানো শুরু হবে। যেহেতু নতুন দল, কিছুটা সময় লাগবে। দল গোছানো হয়ে গেলে ৩০০ আসনেই ভোটের মাঠে আমরা নামার প্রস্তুতি নেব। তবে নির্বাচনে কীভাবে অংশ নেওয়া হবে সে বিষয়ে দলগতভাবে কিছু জানায়নি জাতীয় নাগরিক পার্টি। আপাতত দল গোছানো এবং আগামী ঈদের পরপরই দলটির নিবন্ধনের দিকেই মনোযোগ তাদের।
দলগুলো নিবন্ধনের জন্য ইসির কাছে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয়, অন্তত ১০০টি উপজেলায় উপজেলা কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হবে। এ ছাড়া দলের গঠনতন্ত্র, লোগো এবং পতাকার ছবি, দলের তহবিলের উৎস, ব্যাংক হিসাব জমা দিতে হয়।
এনসিপির নেতারা জানিয়েছেন, নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালার শর্তসমূহ মার্চের মধ্যে পূরণ করতে চায় নতুন রাজনৈতিক দলটি। এ লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠনের জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছ।
এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেন, দল আত্মপ্রকাশের পর আমরা এখন নিবন্ধনের শর্তাবলির প্রতি গুরুত্বারোপ করছি, সংগঠনিক বিস্তারে মনোযোগ দিয়েছি। রোজার পর এগুলো পুরোদমে চলবে। এরপর আমরা ভাবব।
সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে দলটির শীর্ষ নেতারা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় ভোট বাড়াতে প্রচারণা শুরু করেছেন। অনেকে ঢাকায় থেকে এলাকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাজে লাগালেও কেউ কেউ আবার নিজ এলাকায় মাঝেমধ্যে দৌড়ঝাঁপ করছেন। সব আসনেই তারা যোগ্য প্রার্থী দিয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিতে চান। দলের নেতারা নিজ নিজ সংসদীয় আসন এলাকায় শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারলে নির্বাচনে জোটবদ্ধ হলে আসন নিয়ে হিসাব-নিকাশ সহজ হবে। তাই আসনভিত্তিক নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে কাজ করছেন নেতারা।
এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম রাজধানীর দুটি আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন। আসনগুলো হলো ঢাকা-৯ ও ঢাকা-১১। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন নিজ এলাকা রংপুর-৪ থেকে নির্বাচন করতে পারেন।
এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী চাঁদপুর-৫ কিংবা ঢাকা-১৮, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ভোলা-১, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বরিশাল-৫, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ কুমিল্লা-৪, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম পঞ্চগড়-১, যুগ্ম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ নোয়াখালী-৬ থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। অন্যদিকে দুই ছাত্র উপদেষ্টা পদত্যাগ করে দলে যোগ দিলে মাহফুজ আলম লক্ষ্মীপুর-১ এবং আসিফ মাহমুদ কুমিল্লা-৩ থেকে নির্বাচন করতে পারেন বলে এনসিপি সূত্রে জানা গেছে।
এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের টার্গেট ৩০০ আসন। আমরা সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি। তবে নির্বাচনের পরিস্থিতি বুঝে জোট গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে এনসিপি ভোটের মাঠে এককভাবে নির্বাচনে আসবে কি-না প্রশ্নের জবাবে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচনে অংশ নিতে এনসিপি প্রস্তুত। মাত্র আত্মপ্রকাশ করেছে আমাদের দল। তাই নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করতে কাজ করছি। জোট কিংবা প্রার্থী দেওয়ার কথা এখন ভাবছি না।