ইনকিলাব প্রতিবেদন: ‘ছোট ছোট বালু কণা, বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল’ (জুলিয়া অ্যাবিগেল)। মার্কিন কবির ইংরেজি কবিতার এই বঙ্গানুবাদ বাংলা ব্যাকরণে বহুল ব্যবহৃত। কবিতার সারমর্ম হচ্ছে ছোট ছোট বালুকণা যেমন মহাদেশ তৈরি করে, তেমনি বিন্দু বিন্দু পানি মহাসাগরের জন্ম দেয়। সামান্য অপরাধের পথ ধরেই আসে মহাপাপ। গতকাল পতিত আওয়ামী লীগের হরতাল কর্মসূচি ছিল।
পালের গোদা হাসিনার ভারত পালানোর পর আওয়ামী লীগের এটা দ্বিতীয় হরতাল। হরতাল কর্মর্সচি পালিত হচ্ছে এটা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সাধারণ মানুষ তেমন অবগত ছিলেন না। তবে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ হাসিনা ফেসবুকে বক্তব্য দেয়ার পর গভীর রাতে সারাদেশে হরতাল সমর্থনে মশাল মিছিল বের হয়। সাতক্ষিরার মেটেপথে মিছিলে দেখা যায় ৬ জন মানুষ বোরকা পড়ে মশাল নিয়ে মিছিল করছেন।
চট্টগ্রামের জামালখান, ফরিদপুরের সালনা, ঢাকার মিরহাজির বাগ, নারায়ণগঞ্জের বালুরমাঠ, রুপগঞ্জ, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, বান্দরবানের জঙ্গল, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, ভোলা, পটুয়াখালি, ফেনিসহ কিছু জেলায় মিছিল হয়েছে। মিছিল মানে গভীর রাতে ৫ থেকে ২০ জন মানুষ হাতে জলন্ত মশাল নিয়ে জঙ্গলের ধারে, ক্ষেতের জমির আলে, গ্রামের কাঁচা রাস্তায়, জঙ্গলের ধারে, বনের ভিতরের পায়ে হাঁটা সরু পথে মিছিল করেছে। আওয়ামী লীগের এই মিছিল সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলেও হরতাল জনজীবনে কোনো প্রভাব ফেলেনি।
কিন্তু পলাতক হাসিনার মিডিয়া ফৌজরা সোশ্যাল মিডিয়ায় হরতাল নিয়ে ব্যপক প্রচারণা চালাচ্ছে; ভাবখানা আওয়ামী লীগ যেন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আবারও হাসিনা দেশে ফেরার হুমকি দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ৫ আগস্ট হাসিনা পালানোর পর আওয়ামী লীগ নেতারা কেউ কারাগারে কেউ বিদেশে পালিয়েছে। বিদেশে পালাতে কারা সহায়তা করেছে তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। দেশে যারা রয়েছে তারা গর্তে লুকিয়ে আছে; পুলিশ কেন তাদের ধরতে পারছে না তা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
গভীর রাতে শেয়ালের মতো আওয়ামী লীগের এই ডেভিলরা হরতালের সমর্থণে তথাকথিত মিছিল করছে; এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিদেশে পাচার করা টাকা খরচ করে এসব ছবি আন্তর্জাতিক সম্প্রদাযের দৃষ্টি আকর্ষণে ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে আইন শৃংখলা বাহিনী কি করছে? ঢাকঢোল পিটিয়ে যৌথ অভিযান, ডেভিল হান্ট অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের কতজন ডেভিল ধরা পড়ছে? আওয়ামী লীগের রাঘব- বোয়াল ডেভিলদের ধরতে না পারার নেপথ্যের রহস্য কি? গণহত্যা করে পালানো হাসিনার অলিগার্ক ডেভিলদের ছোট ছোট মিছিল এক সময় তো বৃহৎ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামবে তখন কি হবে? সারাদেশে ডেভিল হান্ট চলছে। এর মধ্যে জাতিসংঘের তদন্তে চিহ্নিত মানবতাবিরোধী দল আওয়ামী লীগের মিছিল হচ্ছে, শয়তানরা (ডেভিল) মশাল জ্বালিয়ে মিছিল করছে; অথচ তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না।
তাহলে কি ‘সর্ষের ভিতর ভুত’ প্রবাদের মতো প্রশাসনের ভিতরে ডেভিল রয়ে গেছে?
ইতিহাস বলে, যুদ্ধে যারা বিজয়ী হন তারাই ইতিহাস রচনা করেন; পরাজিতরা ইতিহাস রচনা করে না’। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগ হরতালের ইতিহাস রচনা করছে। দিল্লির দাদাদের কোলে বসে হাসিনা একদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন; অন্যদিকে দলের নেতাকর্মীদের (জনগণের ভাষায় ডেভিল) মাঠে নামাচ্ছে। আওয়ামী লীগের হরতাল কোনো প্রভাব না পড়লেও পলাতক নেতারা হরতাল করার সাহস পায় কোথা থেকে? হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের ডেভিলরা গভীর রাতে চোরের মতো মিছিল করছে অথচ আইন শৃংখলা বাহিনী ডেভিল ধরতে পারছে না? জুলাই আগস্টের চেতনা কি ঝিমিয়ে পড়ছে?
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও তাদের অনুগত কয়েকটি দল বাদে দেশের সব ডান-বাম-মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, আমজনতার অংশগ্রহণ ছিল ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে। হাসিনা পালানোর পর সাড়ে ৬ মাস হয়েছে। কিন্তু হত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং বিচার প্রক্রিয়ায় তেমন অগ্রগতি নেই। বাঘ মানুষের গোশতের স্বাদ পেলে বাঘের যে দশা হয়; বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের হয়েছে সেই দশা। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে তারা এখন রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বিএনপি যেনতেন প্রকারে নির্বাচন হলেই ক্ষমতা নিশ্চিত বুঝতে পেরে বিপ্লবের পর প্রতিবিল্পব হতে পারে সেদিকে দলটির নেতাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। আর জামায়াতের অবস্থা অনেকটা সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী বিদিশার মতো।
মেধাবী বিদিশা কেবল এরশাদের স্ত্রী হওয়ার পর ‘মুই কি হনুরে’ ভাবের কারণে ‘তালাক’ খেয়েছেন। হাসিনা পালানোর পর ‘নিষেধাজ্ঞা’ উঠে যাওয়ায় জামায়াতের অবস্থা অনেকটা বিদিশার মতোই ‘মুই কি হনুরে’। দেশের রাজনৈতিক অবস্থায় বিএনপি যদি হয় বোয়াল মাছ তাহলে জামায়াত পুঁটি মাছ। পুঁটি মাছ হয়েও জামায়াত এখন বোয়ালমাছ বিএনপির সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে।
ভারতের কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় গতকাল মঙ্গলবার ‘বিএনপিকে ঠেকাতে ছাত্রদের দল তৈরির পেছনে কি জামায়াত?’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বোঝানো হয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে তার পিছনের রয়েছে জামায়াতে কূটচাল। দলটির ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতাদের অনেকেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র সমন্বয়ক হয়েছেন। তাদের ‘ব্যবহার’ করে জামায়াত আগামী নির্বাচনে বিএনপির বিপক্ষে ছাত্রদের নতুন দলের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গড়তে চায়।
এছাড়াও দিল্লির এজেন্ডা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি, সংস্কারের নামে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানো এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রদের নতুন সংগঠন তৃর্ণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী করার পক্ষ্যে অবস্থান নিয়েছে দলটি। এমনকি ‘বগলে ইট মুখে শেখ ফরিদ’ প্রবাদের মতো মুখে শেখ হাসিনার বিচার দাবি এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলেও আওয়ামী লীগকে নির্বাচন ও রাজনীতিতে সুুেযাগ করে দিতে চায়।
তাই আওয়ামী লীগের কথিত হরতাল কর্মসূচির দিন জামায়াত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে? অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ ও ‘অপশাসন-নির্যাতনের’ প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি ও ১৮ ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। গত ২৮ জানুয়ারি দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। অথচ ডেভিলদের হরতাল কর্মসূচির দিন জামায়াত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে দলটির সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে।
বিক্ষোভের কী আর সময় ছিল না? এটা ঠিক আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জুডিশিয়াল কিলিং করে জামায়াতের কয়েকজন নেতাকে ফাঁসি দেয়ার নামে কার্যত হত্যা করেছে। দলটির নামেবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী কারাগারে অসুস্থ হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসার অভাবে তার মৃত্যু হয়। সাঈদীর চিকিৎসার দায়িত্বপ্রাপ্তা ডাক্তার আওয়ামী লীগের নেতা প্রফেসর ডা. এস এম জামান মাওলানা সাঈদীকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে স্বীকার করে বলেছেন, ‘রোগী (মাওলানা সাঈদী) যে অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে; সে অবস্থায় চিকিৎসাশান্ত্রে রোগীকে প্রথমে একটি টিকা দেয়া হয়।
আমরা রোগীকে (সাঈদী) সে টিকা দিতে প্রস্তুতি নিলেও উপরের নির্দেশে তা দেয়া হয়নি’। প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত হয়ে এটিএম আজহারুল ইসলাম এক যুগ ধরে কারাগারে। তার মুক্তির দাবিতে দিনের পর দিন কর্মসূচি গ্রহণ, জনমত গঠনসহ নানা ধরনের কর্মর্সচি পালন করা যেত। যদিও বিচার প্রক্রিয়াটি আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। সেটা না করে আওয়ামী ডেভিলদের হরতালের দিন জামায়াতকে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে হলো কেন? এ প্রসঙ্গে ইউটিউব চ্যানেলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের হরতাল পালন করছে।
এ সুযোগ দেয়া হলে ছোট ছোট কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এক সময় বড় কর্মসূচি দেবে। তখন সরকার কি করবে? আর আওয়ামী লীগের হরতালের দিন জামায়াতকে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিতে হলো কেন? ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার বিজয় হলেও পরাজিত হাসিনা এখনো দমে যাননি। অতএব বিপ্লবের বিজয়ী সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়/আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়’। ফ্যাসিস্ট হাসিনা কল্পনাও করতে পারেননি তাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। অতএব ৫ আগষ্টের বিজয়ী সকল শক্তিকে বিভেদ এবং দেশের বিরুদ্ধে মীরজাফরী নয়; সতর্ক এবং ঐকবদ্ধ থাকতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :