ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন।। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে৷ গত ১১ অক্টোবর আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘‘আগামী অক্টোবরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে দুই-তিনটি মামলার রায় হয়ে যাবে৷” শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০৮টি হত্যা মামলা হয়েছে যার মধ্যে ১৬টি ট্রাইব্যুনালে গেছে৷
গত সপ্তাহে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও এ বিষয়ে কথা বলেন৷ সরকার নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা বাসসকে তিনি বলেন, "রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে৷” তিনি আরো বলেন, "এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একধরনের ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে৷”
৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের আরেকটি সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে৷ তারা বলছে, শেখ হাসিনার বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসন অসম্ভব৷ অন্তর্বর্তী সরকার এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে৷ বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৷
সংগঠনটির মূখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জাতি সংঘের প্রতিবেদনের পর শেখ হাসিনা এখন আন্তর্জাতিভাবে স্বীকৃত সন্ত্রাসী৷ তার দল আওয়ামী লীগও সন্ত্রাসী দল৷ গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশ , প্রশাসন ও তার দলকে ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে৷ শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়৷ আর বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ রাখতে হবে৷”
জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, " আয়না ঘরের ভয়ঙ্কর চিত্র তো আমরা দেখলাম৷ একই দিনে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনা এবং তার দল গণহত্যায় জড়িত৷ আমরা শুধু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নয়, আওয়ামী লীগের বিচারও চাই৷ সেজন্য যদি আইনের কোনো সংশোধন দরকার হয়, সকারকে তা করতে হবে৷ আর শুধু শেখ হাসিনা নয়, যারা যারা গণহতায় জড়িত, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে৷”
তিনি মনে করেন, "আওয়ামী লীগ দল হিসেবে তার বৈধতা হারিয়েছে৷ আর পুরো গণহত্যার মাস্টার মাইন্ড ওই দলটির প্রধান শেখ হাসিনা৷ ফলে, দল বলেন আর শেখ হাসিনা বলেন, কারুরই আর রাজনীতিতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ নাই৷”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স অবশ্য মনে করেন আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "সর্বশেষ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পর যেভাবে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে তাতে এখন যদি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ঠিকমতো চলে, তাহলে আওয়ামী লীগের দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভবনা দেখছি না৷ কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা অন্যদের হারিয়ে ক্ষমতায় আসে বা সরকারে আসে, তারা যদি আবার অপকর্মের সঙ্গী হয়, তখন কিন্তু পুরনোরা আবার সুযোগ পেয়ে যায়৷ সুতরাং, সব কথা বলার সময় বোধ হয় এখনো আসেনি৷”
তবে তিনি আরো বলেন, "শেখ হাসিনা গণহত্যার অপরাধ করেছেন৷ তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার পুলিশ, প্রশাসন, দলীয় নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করেছেন৷ তার বিচার প্রক্রিয়া চলছে ৷ যদি সুষ্ঠু বিচার হয়, তাহলে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন৷ আর সেটা হলে তার তো আর রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ নাই৷”
এ সময় নিজেদের আগের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘আমরা শুরু থেকেই কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নই৷ আমরা চাই, ব্যক্তির অপরাধের বিচার৷”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, "আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার চেয়েও জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর আমি ভাবছি কোন মুখে আওয়ামী লীগ বা তাদের নেত্রী রাজনীতিতে ফিরে আসার চিন্তা করতে পারে৷ তাদের তো এখন লজ্জায় মুখ ঢাকার কথা৷ এখন জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর তাদের অপরাধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত৷ এরপর তাদের আর রাজনীতি করার অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না৷”
"এখানে শেখ হাসিনা একাই নয়, তাদের দলের নেতারা সব পর্যায়ের রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে৷ হত্যা, গুমের সঙ্গে তারা জড়িত৷ তাদের রাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ আমি দেখি না,” বলেন তিনি৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "শেখ হাসিনাসহ একাংশ দেশের বাইরে পালিয়েছে৷ যারা এখানে পালিয়ে আছে, তারাও বিভ্রান্তির মধ্যে আছে৷ শেখ হাসিনা দেশের বাইরে থেকে নানা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করছেন৷ তারা হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন৷ কিন্তু সেই স্বপ্ন , স্বপ্নই থেকে যাবে৷”
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও তার দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কথা থাকলেও সুপারিশে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হোক তা তারা চায় না৷ সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেন, "জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে যদি আওয়ামী লীগ ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে তাহলে এটা তাদের জন্য ইতিবাচক৷ আর যদি ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে না পারে তাহলে এটা তাদের জন্য নেতিবাচক৷ জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন কিন্তু তারা উড়িয়ে দিতে পারবে না৷ কারণ, তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে৷ এই প্রতিবেদনে ব্যক্তি শেখ হাসিনার অনুকুলে যায় এমন একটি তথ্যও নাই৷ এটা প্রমাণ হয়েছে যে, শেখ হাসিনা একজন অপরাধী৷ ফলে আমার বিবেচনায় শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের জন্য এখন একটা বোঝা৷ আওয়ামী লীগ যদি শেখ হাসিনাকে নিয়ে অগ্রসর হতে চায়, তাহলে সেটা হবে হ্যান্ডেল ভাঙা স্যুটকেসের মতো৷ আর যদি আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাকে ত্যাগ করে নতুন করে দল পুনর্গঠন করে, অপরাধীদের বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব ঠিক করে, তাহলে আগামীতে খুবই ভালো অবস্থানে যেতে পারবে৷ আর শেখ হাসিনাকেসহ এগোতে চাইলে আগামীতে আওয়ামী লীগ তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় যাবে৷”
"দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না৷ কারণ, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়৷ আমি বলছি না, এটা মানতে হবে৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা মানবে না,” বলেন তিনি৷
মাসুদ কামাল মনে করেন, "গত ৪০ বছরে শেখ হাসিনা দলটিকে এমনভাবে চালিয়েছেন যাতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এক হয়ে গেছে, সমার্থক হয়ে গেছে৷ ফলে নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ শেখ হাসিনা ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না৷ এটাই এখন তাদের সমস্যা৷”
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, "জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়নি৷ তারা কোনো দলকে নিষিদ্ধ চায় না৷ কিন্তু সমস্যা হলো, দলটির নেতা এবং তাদের অনুসারীরা হত্যা, গণহত্যাসহ এত বেশি অপকর্ম করেছেন যে, এখন তারা মানুষের কাছে যেতেই পারবেন না৷ জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর তাদের জন্য পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে গেল৷ কারণ, এই প্রতিবেদন এই সরকার করেনি, করেছে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান৷ আর শেখ হাসিনা ও তার সহাযোগীদের তো বিচার হচ্ছে৷ তারা যদি দণ্ডপ্রাপ্ত হন, তাহলে তো রাজনীতি করার আর কোনো সুযোগই থাকবে না৷”
তার মতে, "শেখ হাসিনা দেশের বাইরে বসে নানা কথা বলে আরো পরিস্থিতি খারাপ করছেন৷ দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছেন৷ এতে তার প্রতি, তার দলের প্রতি মানুষের ঘৃণা আরো বাড়ছে৷ তার চুপ থাকাই ভালো৷”
আপনার মতামত লিখুন :