এল আর বাদল : আদতে কুমিল্লার মানুষ, কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নন্দীর নামাঙ্কিত মেট্রো স্টেশনের পিছনের জনবহুল এলাকায় গত প্রায় ছয় মাস ধরে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের পিছনের ওই বিত্ত-মধ্য এলাকার সারি সারি নীল, হলুদ, গোলাপি চার-পাঁচ তলা বাড়ির ফাঁকে যে গলি, সেই গলির ভিতর থেকে আরো ভিতরে আবহাওয়া থমথমে।
বাড়িগুলি প্রায় সবই হোটেল। সস্তার। সেই হোটেলের অলিতে-গলিতে দুই-তিনজনের জটলা। কথা বলছেন ফিসফিস করে, নির্জন গলিতেও। মানুষের পায়ের শব্দে চলে যাচ্ছেন এদিক-ওদিক, ডাকলেও পিছনে তাকাচ্ছেন না আর। এর কারণ বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান। সূত্র- ভয়েস অফ আমেরিকা
ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে বাজেট হোটেল গজিয়ে ওঠার কারণ অঞ্চলে গত বিশ বছরে একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের বাড়বাড়ন্ত। এখানে রোগীদের বড় অংশই বাংলাদেশের মানুষ। তাই ভাতের হোটেল, স্ন্যাক বার, ক্যাফে, ওষুধের দোকান – এ সবই হয়েছে বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখে।
নীল-গোলাপি হোটেলের নাম তাই বনানী, গুলশান বারিধারা, নিউ বনানী প্রভৃতি। এখানে যারা রয়েছেন, এদের প্রায় প্রত্যেকেরই রয়েছে দীর্ঘকালীন বৈধ ভিসা। কিন্তু কেউই কথা বলবেন না। যাঁরা ঢুকেছেন তাঁদের প্রায় সবাই পালিয়ে এসেছেন, প্রাণের ভয়ে, বললেন অঞ্চলে পরিচিত এক ব্যক্তি, যাঁকে শুধুমাত্র ‘ভৌমিক বাবু’ বলেই সবাই চেনেন। তিনি এক হোটেলের ম্যানেজার, বরিশাল থেকে কলকাতা এসেছিলেন বহু দশক আগে। তিনি কয়েকটি কথা বললেন।
এখন যারা আসছেন তারা বিশেষ পয়সাকড়ি নিয়ে আসতে পারেননি। এরা একেবারে ছোট বা মাঝারি চাকরি বা ব্যবসা করতেন। সেই সূত্রেই দলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন। আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের পরে এরা বাধ্য হয়েই পালিয়ে এসেছেন, তিনি বললেন।
অনেক অনুরোধ-উপরোধের পরে তিনি নিয়ে গেলেন বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক উচ্চপদস্থ কর্তার ঘরে। কিন্তু একাধিক শর্তসাপেক্ষে। ওনার নাম, পদ, কাজের জায়গা, জেলা কিছু নিয়েই একটি শব্দও লেখা যাবে না। উনি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন, কারণ পরিবার দেশেই রয়েছে। উনি আমার অতিথি, ওনার বিপদ আর বাড়াতে চাই না, বললেন ভৌমিক বাবু।
সবুজ-সাদা রং করা ঘরের কোনে বিছানায় বসে এক সময়ের প্রভাবশালী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলা। ছোটখাটো চেহারা, চুল কম, বয়স ৫৫-৬০, মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। দৈনিক ৫০০ টাকা দিয়ে এক কামরার ঘরে থাকতে হচ্ছে ওই আমলাকে যিনি মাস তিনেক আগেও থাকতেন প্রশস্ত সরকারি বাংলোয়।
প্রায় কোনো টাকাই নিয়ে আসতে পারিনি। ভেবেছিলাম সংঘাত মিটে গেলে অপেক্ষা না করে অবসর নিয়ে নেব। এককালীন টাকা পয়সাও পাওয়া যেতো, পেনসনও। সবই আটকে গেল, দেশও ছাড়তে হলো,” ধীরে ধীরে বললেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অফিসার। তাঁর পরিচিতদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন।
আমার সঙ্গে যারা কাজ করতেন, তারা বলছেন, ‘স্যার এখন ফিরবেন না। পরিস্থিতি খারাপ।’ আমার পরিচিতদের মধ্যে কেউ না কেউ প্রায় রোজই গ্রেফতার হচ্ছেন। এই অবস্থায় কিভাবে ফিরব? প্রশ্ন ওই হিন্দু আমলার।
তবে বেছে বেছে শুধুমাত্র হিন্দুদের আক্রমণ করা হচ্ছে, এটা তিনি মনে করেন না।
যারা বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগ করতেন বা দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, তাঁরা সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন। সব জায়গায় সংখ্যালঘুদের কিছু বাড়তি সমস্যা থাকে, তা অবশ্যই আছে। তবে শুধুমাত্র হিন্দুদের আক্রমণ করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি না, তিনি বলেন।
বাংলাদেশ থেকে এই মুহূর্তে ১৫-২০ হাজারের মত মানুষ চিকিৎসার জন্য বৈধ ভিসা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন বলে জানালেন রাজ্য সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের এক অফিসার। বললেন, এদের মধ্যে কতজন ৫ আগস্টের পরে ঢুকেছেন, সেই পরিসংখ্যান দেওয়া মুশকিল। এছাড়াও, অবৈধ ভাবে অনেকে ঢুকেছেন। তবে পরিসংখ্যান নেই,” বলে জানালেন ওই অফিসার।
মধ্য কলকাতায় থাকার সমস্যা-
যারা বৈধ ভাবে এসেছেন তাদের মধ্যে ‘সুপার ভিআইপি’ যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন ওই মাঝারি মাপের আমলা থেকে একেবারেই ছোটখাটো আওয়ামী লীগ কর্মী যারা নিজ নিজ অঞ্চলে রেস্তোরাঁ, দোকান বা ব্যবসা চালাতেন। এরা যে পার্টির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলতেন তাঁরা নিজেরাই তা স্বীকার করছেন। কি করবো বলুন? প্রশ্ন তাপস মজুমদারের।
তাপস মজুমদার যে তার প্রকৃত নাম নয় এবং তিনি যে ধর্মে মুসলমান তা জানিয়েই, রোগা-পাতলা ছাত্রলীগের ওই সাবেক কর্মী তাঁর লীগ করার ব্যাখ্যা দিলেন। আপনাদের এখানে কি তৃণমূল কংগ্রেস না করে আপনি নির্মাণ কাজে চুন-বালি-ইট-সুড়কি সরবরাহ করতে পারবেন? আমি তো তাই করতাম। সেই জন্যই আমায় লীগ করতে হতো। কাল অন্য দল এলে সেই দল করবো,” বক্তব্য তাপসের।
তার আক্ষেপ, এখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরা তাঁর মতো সাধারন লীগ-কর্মীর সীমাবদ্ধতা বুঝছেন না। তাপসের সঙ্গে দেখা করেছিলাম মধ্য কলকাতার মার্কুইস স্ট্রিটে। বাংলাদেশ থেকে যারা আসেন, তাদের অনেকেই এখানেও থাকেন। তাপসের সঙ্গে প্রথমে গিয়ে বসলাম ‘সঙ্গম‘ বলে একটি হোটেলের পাশে এক চায়ের দোকানে, সঙ্গে তার এক বন্ধু। তিনি ছদ্মনামও বলতে চাইলেন না।
কথা বলতে বলতে বোঝা গেল দুই বন্ধুই বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন। বললেন, এই অঞ্চলে অনেকেই তাঁদের চেনে। এরা আমার নাড়ি-নক্ষত্র জানে। আমি যে মুসলমান তা এদের অজানা নয়, বললেন তাপস। মার্কুইস স্ট্রিট এবং সংলগ্ন অঞ্চল মুসলমান প্রধান, অবাঙালি মুসলমান।
কিছুদিন আগে আমি এখানকার এক মসজিদে যখন নামাজ পড়তে যাই তখন আমার উদ্দেশ্যে কটুক্তি করে বলা হয়েছে তোরা আওয়ামী লীগ করতিস এখানে আসবি না। দাদা, এই জায়গা আমার জন্য ‘সেফ‘ নয়, বললেন তাপস।
আওয়ামী লীগের উপর দিকের নেতাদের জন্য নয়, কিন্তু নিচের দিকের কর্মী বা ছোট মাপের নেতাদের জন্য কলকাতা যে আর খুব ‘সেফ নয়’ তা বেশ কয়েকবার শুনতে হয়েছে গত কয়েক দিনে। হাওয়াই চটি আর ময়লা জিন্স ও টি-শার্ট পরিহিত তাপস বললেন, নিরাপত্তার জন্যেই মধ্য কলকাতা ছেড়ে তিনি গিয়ে হিন্দু প্রধান দক্ষিণ কলকাতার বিজয়গড়ে গিয়ে উঠেছেন।
আওয়ামী লীগের মূল সমস্যা টাকা-
তাপসদের অস্বস্তি বাড়তে থাকায়, তাদের নিয়ে গেলাম কলকাতার প্রেস ক্লাবে। প্রেস ক্লাবের অতিরিক্ত চিনি দেওয়া দুধ চায়ে চুমুক দিয়ে দুই বন্ধুকে আমার প্রধান প্রশ্নটি করলাম। একটা দল কিভাবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এর কারণ কি বলে তাঁদের মনে হয়?
আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের কর্মী তাপসের ব্যাখ্যা হয়তো বাংলাদেশের মানুষকে অবাক করবে না কিন্তু আমায় করলো। প্রধান সমস্যা টাকা। আওয়ামী লীগ এটা বুঝতেই পারত না ব্যাংকের থেকে কিছু ব্যক্তির হাতে টাকা বেশি হয়ে গেলে দেশ চালানো মুশকিল হয়ে যায়।
দ্বিতীয় কারণ বললেন তাপসের বন্ধু, যিনি কোনো রকম পরিচয় দিতেই নারাজ।
ছাত্রলীগের ৩৫৭ জনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১০৬ জন জামাত বা বিএনপি থেকে টাকা দিয়ে ঢুকেছেন। আওয়ামী লীগের উপরের দিকে নেতারা সদস্য পদ লাখে লাখে বিক্রি করেছেন। আমি আপনাকে তালিকা দিয়ে দিতে পারি কে কত টাকা দিয়েছেন। সব দলই টাকা তোলে। কিন্তু দলের যদি কোনো ধারণা না থাকে, কে কোথায় কত তুলছে বা কে কত দিচ্ছে - তবে এই ভাবেই দল ধসে যায়,” মন্তব্য তাপসের বন্ধুর।
তাপস বন্ধুর বক্তব্যের সূত্র ধরে যোগ করলেন যে শুধুমাত্র টাকা দিয়েই কর্মী-নেতারা আওয়ামী লীগে আসেননি। অনেকেই এসেছেন আত্মীয়তার সূত্রে, আওয়ামী লীগ-বিরোধী পরিবার থেকে বিবাহের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী পরিবারে এসে দলে মিশে গিয়েছেন। কিন্তু পুরনো দলের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ রেখেছেন। এটা আমি দেখেছি, নেতৃত্বও নিশ্চয়ই দেখেছে। কিন্তু তাঁরা কিভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন তা জানি না, তাপস বলেন।
আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সম্পাদকের নাম করে তাপস বললেন, এরা সব কলকাতা এসে রয়েছেন, আপনাদের পুলিশের তত্ত্বাবধানে। এরাই আমাদের মতো কর্মীর থেকে টাকা তুলতেন, ব্যবসা করছি বলে। অথচ আজ এরা বহাল তবিয়তে কলকাতার বড় বড় হোটেলে বা বিশাল বাসা ভাড়া করে রয়েছেন, আর আমরা রয়েছি বস্তিতে, এক বেলা খেয়ে, পরিচয় পাল্টে। নামাজ পড়ার অধিকারটুকুও গিয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :