মহসিন কবির: রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের দূরত্ব বাড়ছে। নেতারা বলছেন সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না। সরকার থেকে পদত্যাগ করে দল গঠন করলে তারা স্বাগত জানাবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন ছাত্র নেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়লে ম্লান হতে পারে অভ্যুত্থানের চেতনা।
সম্প্রতি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপি মহাসচিবের মন্তব্য; এর জেরে তথ্য উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্ট এবং এরও পরে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাল্টা মন্তব্য ঘিরে চলছে নানারকম আলোচনা-পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে করে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়ায় যে ফাটল রয়েছে, সেটি আরও স্পষ্ট হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারের সহযোগিতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে বলে যে গুঞ্জন চলছে, সেই গুঞ্জন এই ফাটলকে আরও বড় করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সম্প্রতি একধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং এক দলের সঙ্গে অন্য দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস, অনাস্থা বাড়ছে।
বিএনপিসহ বেশকিছু দল যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের ওপর বরাবরই গুরুত্বারোপ করে আসছে। এ বিষয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে দাভোসে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জানান, নির্বাচনের সময়কাল নির্ভর করবে দেশের জনগণের প্রত্যাশার ওপর। মানুষ যদি দ্রুত সংস্কার চায়, তাহলে আমরা এ বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েছি। আর যদি বলে, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার দরকার, তাহলে আমাদের আরও ছয় মাস সময় লাগবে।
সরকারের ভেতর থেকে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা হলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, যদি ছাত্ররা সরকারের ভেতরে থেকে দল গঠন করে, তাহলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠবে। ছাত্ররা দল গঠন করবে, খুবই ভালো কথা। আমরা তারুণ্যের শক্তিকে স্বাগত জানাব। কিন্তু কিংস পার্টি গঠন হলে ছাত্রদের আদর্শটা থাকে না। এটা হবে খুবই অপ্রত্যাশিত। এতে পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাবে এবং ক্ষতি হবে এই অভ্যুত্থানের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেছেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিরোধগুলোও তত স্পষ্ট হতে থাকবে। যার-যার স্বার্থের বিষয়ে রাখঢাক সরে যাবে। বিএনপি যদি দেখে, সামনের নির্বাচনে ছাত্ররা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাহলে তারা ছাত্রদের ছাড় দেবে না। এটাই স্বাভাবিক। এটাই রাজনীতি।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এ সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্দলীয়। এটি সাময়িক একটা সরকার। ফলে বিশেষ কোনো দল, আদর্শ বা গ্রুপের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ তাদের নেই।
সাইফুল হক বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, গাছেরটা খাও আবার নিচেরটাও কুড়িয়ে নাও- এমন সুযোগ নেওয়া ঠিক হবে না। এতে সরকারের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস কমে যাবে এবং তরুণ প্রজন্মের মনে ছাত্রদের সম্পর্কে যে সম্ভাবনার স্বপ্ন রয়েছে, শুরুতেই তা হোঁচট খাবে। তিনি যোগ করেন, সম্প্রতি ছাত্রদের মুখের ভাষা, শরীরের ভাষা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দম্ভ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তরুণদের কথাবার্তায় প্রজ্ঞার পরিচয় প্রত্যাশা করেন এই রাজনীতিক। এও বলেন যে, কোনোভাবেই চাইব না ছাত্রদের সঙ্গে, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বেড়ে যাক।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, বিএনপি মহাসচিব বলেছেন সরকারের নিরপেক্ষতা যদি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে তারা নিরপেক্ষ সরকারের দাবি তুলবেন। অপরদিকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, সরকারের কেউ যদি রাজনৈতিক দলে যুক্ত হয় তাহলে তিনি সরকারে থাকবেন না; পদত্যাগ করবেন। এখানে তো আমি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের কোনো বিরোধ দেখি না।
এদিকে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘যদি অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কন্ডাক্ট (পরিচালনা) করা পর্যন্ত থাকবেন। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।’ বিএনপি মহাসচিবের ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লেখা স্ট্যাটাসে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে বলেছেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। এক-এগারোর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা এক-এগারো সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকা-ের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।’
এ ছাড়া দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আমরা শুনতে পাচ্ছি, উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কিংস পার্টি করা হবে। আমরা এ-ও শুনতে পাচ্ছি, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলকে উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এজন্য কি রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না? মানুষের ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকার একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে। অনন্তকাল ধরে তারা সংস্কার করবে, এটা হতে পারে না।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক যে ক্রাইসিসগুলা চলছে, সেখানে লালসন্ত্রাস-গ্রিনসন্ত্রাস আসবে। আমরা ২৪ গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে জাতিগত বিদ্বেষ চাই না, কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম চাই না। যে আদর্শিক বিভাজন বাংলাদেশে রয়েছে, সেখান থেকে আমরা সরে আসতে চাই। বিভিন্ন যে বাদ আছে জিয়াবাদ বলুন, মুজিববাদ বলুন আমরা কোনো বাদ বাংলাদেশে চাই না। আমরা বাংলাদেশে শুধু একটি বিষয় বুঝি, সেটা হলো জনগণ।’
তার এমন বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘আমি বলব, ভাই আপনাকে কে দেখতে বলেছে? কে ঠিকাদারি দিয়েছে আপনাকে? চোখ নাই, মাথা নাই, বুদ্ধি নাই, বিবেচনা নাই! মুজিব আর জিয়া এক জিনিস নয়। মুজিব গণতন্ত্র হত্যা করেছেন আর জিয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :