এল আর বাদল: ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘দালিলিক ভিত্তি’ ছিলো আন্দোলনরত তিন জোটের ঘোষিত রূপরেখা। তখনকার আন্দোলনকারী ও বিশ্লেষকদের মতে এটি ছিলো ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনীতি-রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল’, যা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।
তখন যে তিনটি জোট ওই রূপরেখা প্রণয়ন ও ঘোষণা করেছিলো সেগুলো হলো- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট এবং বাম ঘরানার দলগুলোর সমন্বয়ে পাঁচ দলীয় জোট। এর বাইরে একই দাবিতে জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন করেছিলো, তবে তারা কোন জোটে ছিলো না।
এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে ওই বছরের ১৯শে নভেম্বর জোট তিনটি আলাদা সমাবেশ থেকে একযোগে রূপরেখাটি ঘোষণা করে, যার মূল লক্ষ্য হিসেবে ‘একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ গঠনের লক্ষ্যে এরশাদের পতন’ কে তুলে ধরা হয়েছিলো।
রূপরেখাটি ঘোষণার সতের দিনের মাথায় ওই রূপরেখার ভিত্তিতেই এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন।
রূপরেখায় থাকা ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৯১ সালের সাতাশে ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
ওই রূপরেখার সাফল্য হলো এরশাদের পতন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হওয়া। কিন্তু পরে দুই প্রধান দল নিজেদের রূপরেখাকে শুধু উপেক্ষাই করেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টো কাজ করেছে, বলছিলেন গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ।
আর বেসরকারি সংস্থা সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলছেন রূপরেখায় করা অঙ্গীকার ১৯৯১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দলগুলো মেনে চললেও পরে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন ছাড়া আর কিছুই হয়নি, বরং ‘পুরো উল্টো পথে গেছে দলগুলো যার পরিণতি হলো এবারের গণঅভ্যুত্থান’।
কীভাবে রূপরেখাটি প্রস্তুত হয়েছিলো-
রূপরেখা তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন কিংবা খুব কাছ থেকে দেখেছেন এমন কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে রূপরেখা তৈরি সম্পর্কে কয়েক ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।
এরশাদ বিরোধী তিন জোটের মধ্যে আলোচনা ও কর্মসূচি সমন্বয়ের জন্য গঠিত লিয়াজো কমিটিতে ছিলেন বিএনপির এখনকার জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। মি. হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন এই লিয়াজো কমিটিই রূপরেখাটি চূড়ান্ত করেছিলো।
সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন তখনকার তিন জোটের নেতাদের পরামর্শে রূপরেখার খসড়াটি তিনিই দাঁড় করিয়েছিলেন, যা পরে তিন জোটের লিয়াজো কমিটিতে পরিমার্জন করার পর বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন পেয়ে চূড়ান্ত হয়।
অন্যদিকে নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একজন নুর আহমেদ বকুল বলছেন তারা তখনকার আওয়ামী লীগ নেতা টাঙ্গাইলের প্রয়াত আব্দুল মান্নানের ঢাকার বাসায় রূপরেখাটির খসড়া দেখেছিলেন। মি. বকুল এখন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।
আবার আরেকটি বর্ণনায় জানা যায় রূপরেখাটির একটি খসড়া হাতে লিখেছিলেন রাশেদ খান মেনন। এর ভিত্তিতে তিনটি জোটে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। পরে এর ভিত্তিতে ডঃ কামাল হোসেন, প্রয়াত আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও আব্দুল মান্নান খসড়াটি পরিমার্জন করেন।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে আব্দুস সালাম তালুকদার, আব্দুল মতিন চৌধুরী, খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ আরও কয়েকজন এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
এটিই পরে তিন জোটকে দেয়া হয় নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য। জোটগুলো নিজেরা আলোচনা শেষে লিয়াজো কমিটি তা চূড়ান্ত করে। এরপর তিন জোটের আলাদা আলাদা সমাবেশ থেকে রূপরেখা ঘোষণা করা হয়।
তবে এ রূপরেখার পটভূমি ছিল ১৯৮৮ সালের নির্বাচন। যার পর থেকেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছিলো। তখন নির্বাচনে মাত্র ছয়টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল।
আন্দোলন ব্যাপক গতি পায় ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে এবং আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যেও ইস্যুভিত্তিক ঐক্য গড়ে ওঠে। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও দুটি জোট হয় তখন।
এর মধ্যে দশই অক্টোবর ছাত্রদল নেতা জেহাদ মারা যাওয়ার পর জেহাদের মরদেহ সামনে রেখেই ২৪টি ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করে। এরপর সাতাশে নভেম্বর গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হলে এরশাদের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
মূলত এই ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বেই তুমুল আন্দোলন হয়, যার জের ধরে নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে পদত্যাগে সম্মত হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
কিন্তু এর আগে থেকেই এরশাদ কীভাবে পদত্যাগ করবেন বা কার কাছে পদত্যাগ করবেন তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ এরশাদ পদত্যাগ করলে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদের কাছেই করতে হতো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ চাই ও এরশাদের পতন চাই-এমন দাবি ছাত্রদের মধ্য থেকেই উঠেছিলো। এ কারণে একটি রূপরেখার কথা ওঠে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বৈঠকে। প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল মান্নানের বাসায় এ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ আন্দোলনরত দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। এর মধ্য দিয়েই রূপরেখাটি তৈরির কাজ শুরু হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তখনকার সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা নুর আহমেদ বকুল।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছেন, যে নেতাদের আলোচনার ভিত্তিতে রূপরেখার খসড়ার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিলো এবং ওই কমিটিতে থেকে তিনিই খসড়াটি লিখেছিলেন।
আমরা এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর কিভাবে করবে, নির্বাচন কীভাবে হবে এবং নির্বাচনের পর দেশ ও রাজনীতি কিভাবে এগুবে সেগুলোর ভিত্তিতে একটা খসড়া তৈরি করলাম। আমরা তাতে তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা লিখেছিলাম। পরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পরামর্শে ‘তিনটি নির্বাচন’ বাদ দিয়ে শুধু পরবর্তী নির্বাচনের কথা লেখা হয় রূপরেখায়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ অবশ্য বলছেন রূপরেখাটিতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও নির্বাচনের দিক নির্দেশনার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পূর্ণ ছিলো।
তবে এতে কিন্তু জোটগুলো কোন স্বাক্ষর করেনি। তারা তখন সমাবেশ থেকে ঘোষণা দিয়েছিলো। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর না থাকায় ঐক্যমত থাকা সত্ত্বেও এটি একটি জাতীয় সনদ হতে পারেনি, বলছিলেন তিনি।
কী বলা হয়েছিলো রূপরেখায়
তিন জোটের রূপরেখার যে প্রচারপত্র তখনকার সরকার-বিরোধী আন্দোলনরত দলগুলো প্রকাশ করেছিলো তাতে দেখা যায় যে শুরুতে রূপরেখার লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছিলো, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের দুঃশাসনের কবল হতে মুক্তিকামী জনগণ এরশাদ সরকারের অপসারণের দাবিতে এবং দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা ও জীবনপদ্ধতি কায়েম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুন: প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলমান গণআন্দোলনে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ এক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তখনকার সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন। টানা নয় বছর ক্ষমতায় থেকে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
এই নয় বছর এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছিলো রাজনৈতিক দলগুলো। তবে শেষ পর্যন্ত তার পতন হয়েছিলো তুমুল ছাত্র বিক্ষোভে। নয় বছরের ওই আন্দোলনের কর্মসূচিতে মারা গেছে সাড়ে তিনশোর বেশি মানুষ।
তিন জোটের রূপরেখায় আরও বলা হয়েছিলো যে, “এই সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন, এমন কি মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে একটি প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
এরপরেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেই কেবল আন্দোলনরত জোটগুলো অংশ নেবে বলে বলা হয় রূপরেখায়।
আপনার মতামত লিখুন :