চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান ‘বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের নতুন সুযোগ দিয়েছে।’ এমনটাই মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওয়াশিংটনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন। অনুবাদ করেছেন: আজকের প্রত্রিকা
সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল বিএনপির অবস্থান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন এবং বাংলাদেশের বর্তমান আলোচিত বিষয়গুলোর ওপর নিজের মন্তব্য তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নয়া দিল্লিতে অবস্থিত সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে গবেষক শাহাদাত হোসেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে প্রায়ই ‘ফ্যাসিবাদী’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে।
বিএনপির শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০১৬ সাল থেকে দলের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে, তিনি ২০১১ সাল থেকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ছিলেন। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপির সর্বশেষ সরকারে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ঢাকার বাইরে থেকে রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও ধীরে ধীরে তিনি দলের শীর্ষ পর্যায়ে ওঠে আসেন। ২০১১ সাল থেকে মির্জা ফখরুল বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা দলের সবচেয়ে কঠিন সময় হিসেবে বিবেচিত। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করায় ফখরুলই বাংলাদেশে বিএনপির প্রধান নেতা হিসেবে দল পরিচালনা করছেন।
প্রশ্ন: আপনি কি জুলাই বিপ্লবকে একটি ‘বিপ্লব’ হিসেবে দেখেন, নাকি গণঅভ্যুত্থান হিসেবে বিবেচনা করেন?
মির্জা ফখরুল: নিঃসন্দেহে এটি একটি গণঅভ্যুত্থান। প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে বিএনপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলগুলো ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-পীড়ন বন্ধের জন্য লড়াই করে আসছিল। সর্বশেষ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবিতে। বিপুলসংখ্যক ছাত্র রাস্তায় নেমে এসেছিল। এই সময়ে অনেক ছাত্র দুঃখজনকভাবে প্রাণ হারিয়েছে।
শুরুর দিকেই এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের রূপ নেয়নি। তবে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মর্মান্তিক মৃত্যু আন্দোলনে মোড় এনে দেয়। তাঁর মৃত্যুতে পুরো বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একত্র হয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার উৎখাতের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় নামে, যা শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দেয়।
আমরা এটিকে একটি নির্মম ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন এবং বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের নতুন সুযোগ হিসেবে দেখি। ছাত্রদের দাবিগুলো মূলত দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য দূর করার ওপর ভিত্তি করে ছিল। এটি মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য ও সংগঠিত রাজনৈতিক কাঠামোর প্রয়োজন। তাই আমরা জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব দিয়েছি এবং তা নিশ্চিত করতে কাজ করেছি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা সংস্কারের কাজ শুরু করেছে, যা প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের প্রথম ধাপ।
প্রশ্ন: আপনারা জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। তবে একজন উপদেষ্টা সম্প্রতি দাবি করেছেন, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্ব জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু বিএনপি তা মানেনি। আপনার দল সেই প্রস্তাব সমর্থন করেনি কেন?
মির্জা ফখরুল: ছাত্র নেতৃত্বের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার গঠনের কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে আমি জানি না। তবে ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পর, প্রতিনিধিরা আমাদের কাছে এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে মতামত চেয়েছিলেন। তারা কিছু নাম প্রস্তাব করেছিল, আর আমরা সেই অনুযায়ী মতামত দিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: দেশে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই প্রক্রিয়াগুলোতে আপনার দলের প্রতিনিধিত্ব ও সম্পৃক্ততা কীভাবে রয়েছে?
মির্জা ফখরুল: বিএনপির কোনো প্রতিনিধিকে সংস্কার কমিটিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব কমিটি কোনো রাজনৈতিক দলীয় প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই গঠন করা হয়েছে, যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য স্বাভাবিক ও সংগতিপূর্ণ। তবে তারা আমাদের মতামত চেয়েছে এবং আমরা এ কমিশনগুলোতে আমাদের মতামত পাঠাব।
বিএনপি নির্বাচন দাবি করছে এবং বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে বিবেচিত। তবে সমালোচকেরা মনে করছেন, ক্ষমতায় গেলে বিএনপি আরেকটি ‘আওয়ামী লীগে’ পরিণত হতে পারে। বিশেষ করে, ৫ আগস্টের পরের ঘটনাগুলোর ভিত্তিতে বলা হচ্ছে যে, তৃণমূলের অনেক বিএনপি নেতা-কর্মী দখল ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এগুলো বিএনপির বিরুদ্ধে বিরোধী মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলের ছড়ানো নেতিবাচক প্রচারণা ছাড়া কিছুই নয়। গণআন্দোলনের পর এমন ঘটনা বিরল নয়। দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার কথা আমরা অস্বীকার করছি না।
তবে বিএনপি বিষয়গুলো সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত পাওয়া যাওয়ায় এখন পর্যন্ত আমরা প্রায় ৭০০ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেছি। আমরা দলে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি বজায় রাখতে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জন আস্থা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগ সব সময় দাবি করে, অন্য দলগুলো শাসনামলে সংখ্যালঘু হিন্দুরা নিরাপদ থাকে না। ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সবগুলোই কি রাজনৈতিক হামলা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে? এটা কি আওয়ামী লীগের দাবিকেই আরও জোরালো করে না?
মির্জা ফখরুল: কিছু ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে। আওয়ামী লীগের বহু নেতা- কর্মী, যারা অন্যায় করেছে, নির্যাতন চালিয়েছে, লুটপাট করেছে—তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। এ হামলাগুলো বিএনপি বা ছাত্রদের দ্বারা নয়, বরং ১৮ বছরের অপমান, বঞ্চনা ও ক্ষোভ থেকে পরিচালিত হয়েছে।
এই ঘটনাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কেউ কেউ প্রচার করছে যে, ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে,’ যা দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার একটি প্রচেষ্টা। এই প্রোপাগান্ডা আওয়ামী লীগেরই সাজানো, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি তুলে ধরা যায় যে, দেশে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য হলো, ভারতসহ মিত্রদের সমর্থন নিশ্চিত করা এবং নিজেদের এ সমস্যা সমাধানে একমাত্র সক্ষম দল হিসেবে উপস্থাপন করা।
পরিহাসের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের শাসনামলেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
প্রশ্ন: আপনারা ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন এবং জনমতও মনে হচ্ছে আপনাদের পক্ষে। বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে? শেষবার যখন আপনারা ক্ষমতায় ছিলেন, বাংলাদেশ ‘লুক ইস্ট’ নীতির পথে এগিয়েছিল। এবার কি কোনো চমক থাকবে?
মির্জা ফখরুল: আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সহজ। আমরা বন্ধু চাই, প্রভু নয়। সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চাই, কিন্তু কারও অধীনস্থ হতে চাই না। বর্তমান আন্তঃসংযুক্ত পৃথিবীতে যোগাযোগ, ব্যবসা এবং বন্ধুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমরা আত্মনির্ভরশীলতাকে অগ্রাধিকার দেব।
প্রশ্ন: ভারত বাংলাদেশের প্রধান প্রতিবেশী দেশ। আপনার দলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সব সময়ই ওঠানামার মধ্য দিয়ে গেছে। গত এক দশকের চেষ্টাতেও এই সম্পর্কে নতুন কোনো দিগন্ত উন্মোচন সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে বিএনপি-ভারত সম্পর্ক কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মির্জা ফখরুল: আমরা সব সময় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে। এটি আমাদের ঘোষিত নীতির অন্যতম ভিত্তি। জিয়াউর রহমানের সময় থেকেই, আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম, ভারতের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক ধরে রাখতে কাজ করেছি। তবে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপস করা যাবে না।
পানিবণ্টনের মতো বিষয়গুলো সমাধান করতে হবে। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। সংযোগে সমতার নীতি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কাছ থেকে নেওয়া সুবিধাগুলোর সমান প্রতিদান দিতে হবে। এ ছাড়া, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আশা করি, এ ধরনের হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে। বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণই নেবে।
প্রশ্ন: ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রচুর ভুল তথ্য ও মিথ্যা বয়ান (ন্যারেটিভ) ছড়ানো হচ্ছে। এটি নতুন কিছু নয়—আপনার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেও ভারতীয় গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের বলয়ের বাইরে থাকা দলগুলোর প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণত নেতিবাচক। বাংলাদেশ কীভাবে এই সমস্যাটি মোকাবিলা করতে পারে?
মির্জা ফখরুল: মিথ্যা প্রচারণা মোকাবিলার একমাত্র উপায় হলো, জনগণের শক্তিতে গড়া একটি শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করা। প্রথমেই, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে মনে রাখতে হবে যে, আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে সক্ষম। পাশাপাশি, বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী পাল্টা বয়ান (কাউন্টার ন্যারেটিভ) তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য ও ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে বিভ্রান্তি দূর করতে হবে।
প্রশ্ন: তরুণেরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ধারণা নিয়ে আলোচনা করছে। আপনার দল এতে খুব একটা উৎসাহী বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মির্জা ফখরুল: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলতে তারা কী বোঝাচ্ছে? তাদের এই ধারণা স্পষ্ট করা উচিত। আমি জানতে চাই, তাদের নতুন রাজনৈতিক মীমাংসা আসলে কী? আমি এ বিষয়ে কোথাও কিছু লেখা নথিভুক্ত পাইনি। তাদের প্রস্তাব কী, সেটা স্পষ্ট নয়। আমাদের যে ধরনের রাজনীতি আমরা কল্পনা করি, তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে নথিভুক্ত। তাদেরও যদি এমন কোনো স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তবে সেটি প্রস্তাব করা উচিত।
প্রশ্ন: শুধু আপনার দল নয়, আরও অনেক দলই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা জীবন উৎসর্গ করেছে। কেন মানুষ আগামী নির্বাচনে আপনার দলকে ভোট দেবে—এ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন?
মির্জা ফখরুল: বিএনপি জনগণের দল। এটি সেই ধরনের রাজনীতি করে যা জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলে যায়। মানুষ স্বাধীনতা চায়, তারা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাস করতে চায়। তারা চায় ভোট দিতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতাদের নির্বাচিত করতে এবং কাজের সুযোগ পেয়ে উন্নতি করতে। বিএনপি সেই সুযোগ তৈরি করে।
বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় এসেছে, প্রতিবারই নির্বাচনের মাধ্যমে। ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার করেছে। জিয়াউর রহমান (বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) একদলীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করেন। পরে, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত হয়, যা রাজনৈতিক উদ্ভাবনের আরেকটি মাইলফলক।
অর্থনৈতিকভাবে বিএনপি একটি ত্রুটিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক মডেল থেকে সরে এসে মিশ্র ও বৈচিত্র্যময় অর্থনীতি চালু করে, যা আমরা এখন মুক্তবাজার অর্থনীতি হিসেবে চিনি। এরপরই বেসরকারি খাতের অর্থায়ন শুরু হয় এবং অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আজ যে গার্মেন্টস খাত আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি, তা জিয়াউর রহমানের সময়ে শুরু হয়। এমনকি রেমিট্যান্স আসা শুরু হয় তাঁর উদ্যোগের ফলেই।
পরে, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কার হয়। বিএনপি এমন একটি দল, যার জনগণের সমস্যার সমাধান এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। আমাদের দল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করেছে, যা একটি গণতান্ত্রিক দেশের মৌলিক স্তম্ভ।
প্রশ্ন: আপনি বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। নতুন প্রজন্ম—যাদের অনেকেই সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে—দেশের আগামী ৫০ বছরের রাজনীতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন প্রজন্মের রাজনীতির গতিপথ কোন দিকে বলে আপনি মনে করেন?
মির্জা ফখরুল: নতুন প্রজন্ম এরই মধ্যে রাজনীতিতে সক্রিয়, তারা রাস্তায় এবং সরকারের মধ্যে উভয় স্থানেই উপস্থিত। শাসনব্যবস্থায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা আছেন। তাদের প্রধান দাবি হলো, বৈষম্যহীন একটি সামাজিক ব্যবস্থা। তবে, তারা যেসব পরিবর্তন চায় তা নিয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বা লিখিত প্রস্তাব দেখতে পাওয়া যায়নি।
তারা প্রায়ই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে বিপ্লব হিসেবে উল্লেখ করেন। ব্যক্তিগতভাবে, আমি একে বিপ্লব হিসেবে মনে করি না বরং একে ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক পরিবর্তন হিসেবে দেখি। আমি একজন উদার গণতান্ত্রিক হিসেবে বিশ্বাস করি, এমন একটি রাজনীতিতে যেখানে সব দল অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে, কোনো বিধিবদ্ধ অবরুদ্ধ পরিবেশ আমরা চাই না।
জনগণের পক্ষ থেকে একটি রাজনৈতিক দলকে বেছে নেওয়া হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। এ জন্য আমরা দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান ব্যক্ত করেছি। নির্বাচন এখনো পর্যন্ত চলমান অনেক চ্যালেঞ্জ ও বিতর্কের সমাধান করবে। নির্বাচন যত দিন না হবে তত দিন পর্যন্ত বিতর্ক ও আলোচনা চলতে থাকবে।
আমরা দুই বছর আগে সংস্কারের সূচনা করেছিলাম এবং আমাদের প্রচেষ্টা এখনো এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ‘বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে’ অথবা ‘বিএনপি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত’—এর মতো নেতিবাচক বয়ান আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হচ্ছে আমাদের খাটো করে দেখানোর জন্য। আমরা যারা জাতীয়তাবাদী, যারা গণতন্ত্রে দৃঢ় বিশ্বাসী তাদের মতাদর্শ স্বাধীনতার পরিবর্তে অধীনতার পক্ষাবলম্বনকারীদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
আমরা বাংলাদেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চাই, যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা সব সমস্যার সমাধান করবে। আমরা ‘আমি আপনার সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু আমি আপনার বাক স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা করব’—এই মূলনীতি নিশ্চিত করতে চাই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশের একটি বৃহৎ অংশের মধ্যে ব্যাপক দারিদ্র্য আছে। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জরুরি মনোযোগ প্রয়োজন।
প্রশ্ন: আপনার দল প্রায়ই দাবি করে যে, বিএনপি উদার ও গণতান্ত্রিক। আপনার দলের চেয়ারপারসন একজন নারী, তিনি দীর্ঘদিন ধরে দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তবে, আপনার দলে নারীদের প্রতিনিধিত্ব এখনো কম এবং ৩০ শতাংশ নারী প্রার্থী দেওয়ার ঘোষিত লক্ষ্য আপনারা পূর্ণ করতে পারেননি। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মির্জা ফখরুল: আমরা আমাদের দলে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করব। এটি আমাদের একটি অগ্রাধিকার, এবং আমরা এই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আপনার মতামত লিখুন :