ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা ছাত্রদলের ২৪২ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গত বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হয়েছে। এ কমিটি ঘিরে ত্যাগী ও পরিশ্রমীদের বঞ্চিত করা, ছাত্রলীগ ও নতুন বা অপরিচিতদের গণহারে পদায়ন, সভাপতি ও সেক্রেটারির অনুসারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোসহ নানা অভিযোগ তুলেছেন এক অংশের নেতাকর্মীরা, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিতর্কের মুখে এসব অভিযোগ তদন্তে কমিটি করা হয়েছে। সূত্র : কালবেলা
এক অংশের নেতাকর্মীরা বলছেন, এই কমিটির সদস্য সংখ্যা হিসেবে আয়তনে বড় হলেও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। এ ছাড়া তারা প্রশ্ন তুলেছেন, আগস্টের আগে কঠিন সময়ে এত লোকজন ছিল না; কিন্তু পদ নেওয়ার ক্ষেত্রে এত লোকের আনাগোনা কীভাবে? তবে সংগঠনটির নেতারা বলছেন, কমিটিতে যোগ্যতা অনুযায়ী ত্যাগীদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে গতকাল দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের যথাযথ তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসভাপতি জহির রায়হান আহমেদ ও এ বি এম ইজাজুল কবির রুয়েলকে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। তাদের দুই দিনের মধ্যে তদন্ত করে লিখিত আকারে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত মার্চে শাখা ছাত্রদলের সাত সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে সভাপতি হন গণেশ চন্দ্র রায় এবং সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন। এ কমিটিতে সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে ছিলেন মাসুম বিল্লাহ, সহসভাপতি হিসেবে আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাছির উদ্দীন শাওন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শামীম আক্তার শুভ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক নূর আলম ভূঁইয়া ইমন ছিলেন। প্রায় সাড়ে ৮ মাস পর সেই কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয় গত বৃহস্পতিবার। এতে ১৪ জনকে সহসভাপতি, ৪৩ জনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সাধারণ সম্পাদক, ৩৯ জনকে সহ-সাংগঠনিক পদে রাখা হয়েছে।
ঢাবি ছাত্রদলের এই পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন বেশকিছু ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এর মধ্যে একজন হলেন মাহাদী ইসলাম নিয়ন। তিনি ঢাবি ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পেয়েছেন বলে জানা গেছে। এর আগে তিনি শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জাহিদের সঙ্গে রাজনীতি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ফেসবুক আইডিতে ছাত্রলীগের বিভিন্ন প্রোগ্রাম, নির্বাচনী প্রচারে আল-নাহিয়ান খান জয়ের সঙ্গে কাজ করাসহ বেশ কিছু ছবি দেখা যাচ্ছে। তার ফেসবুক টাইমলাইনে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালনে শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের পোস্ট শেয়ার করেছেন তিনি। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’ শীর্ষক মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ছবিও শেয়ার করেন তিনি।
এই কমিটির বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল কাফি বিশ্ববিদ্যালয়ে সনজিত-সাদ্দাম কমিটি থাকাকালে স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সংস্কৃতি সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী ছিলেন বলে জানা যায়।
ক্রীড়া সম্পাদক সাইফ উল্লাহ ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ এবং আরেক কেন্দ্রীয় নেতা সা’দ বিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে ছবি ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে ঢাবি ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বি এম কাওসার বলেন, সাইফ ২০১৯ সাল থেকেই ছাত্রদলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করে আসছেন এবং জহুরুল হক হল কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। হলে থাকার বাস্তবতায় কারও কারও সঙ্গে দু-একটা ছবি থাকতে পারে। তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।
নতুন কমিটিতে জেন্ডার ন্যায্যতা ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন সৈয়দ সুকাইনা নাফিসা তরঙ্গ। তিনি গত ৭ আগস্ট ফেসবুকে খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব বার্বি’ বলে ব্যঙ্গ করেছেন অভিযোগ উঠেছে। এ-সংক্রান্ত একটি স্ক্রিনশট কালবেলার হাতে রয়েছে। যদিও নাফিসা এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমার কিছু ফেসবুক স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট নিয়ে অনেকে খালেদা জিয়ার প্রতি আমার স্ট্যাটাসের ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছে।’ এ ছাড়া তার ব্যাপারে জারিফ আরফান নামে একজন বলেন, নাফিসা তরঙ্গের দীর্ঘদিনের বয়ফ্রেন্ড ইলিয়াস হোসেন তুষার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। লেখক ভট্টাচার্য থাকার সময় শেখ মুজিব হল ছাত্রলীগের ক্যান্ডিডেট ছিলেন।
ছাত্রদলের ধর্ম সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সঙ্গে দুই বছর সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছে এক সূত্র। সূত্র বলছে, তিনি হলে মোস্ট পলিটিক্যাল ছিলেন এবং থাকতেন ‘পলিটিক্যাল রুমে’। শাকিল গ্রুপে রাজনীতি করলেও হল ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসান শান্তর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ঘটনাচক্রে হল ত্যাগ করেন এবং ছাত্রদলে যোগ দেন।
ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমান বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের উপ-মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন। যদিও তিনি ডাকসুতে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে নির্বাচনও করেছেন এবং পরে হল ছাত্রদলের পদও পান।
সহসাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম রিমন সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিয়াম রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া তিনি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, ছাত্রদলের এ কমিটিতে অনেককে পদবঞ্চিত করা হয়েছে এবং অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাবি শাখার সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও বর্তমান কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘নানা ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও আহ্বায়ক কমিটিতে আমার জুনিয়ররা আহ্বায়ক সদস্য হলেও আমি ছিলাম পদবঞ্চিত। ঢাবি ছাত্রদলের কমিটিতে প্রথম মূল্যায়নের দেখা পাই এর পরের কমিটিতে দপ্তর সম্পাদক হিসেবে এসে। অবশেষে আবারও অবমূল্যায়িত হলাম বর্তমান কমিটিতে। আমার বন্ধুদের, এমনকি আমার সহযোদ্ধা, অনুজদেরও যেখানে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হলো, সেখানে আমাকে কোন বিবেচনায় সহ-সাধারণ সম্পাদক করা হলো, তা বোধগম্য নয়। ভবিষ্যতে ছাত্রদলের কোনো কর্মী যেন আমার মতো অবমূল্যায়নের শিকার না হন।’
ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ৫ আগস্টের আগে কঠিন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলে এত লোকজন আমরা দেখিনি। এতদিন পর এসে সুসময়ে হঠাৎ করে এত লোক বেড়ে গেছে, এতে বিস্মিত হচ্ছি। কোনোরকম বাছবিচার, মূল্যায়ন ছাড়াই এত সদস্যকে পদায়ন করার বিষয়টি সংগঠনের জন্য ক্ষতিকর। এতে করে বিগত সময়ে ত্যাগী নেতাকর্মীরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে আগ্রহ হারাচ্ছেন এবং নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অনেক নেতাকর্মী আমাদের কাছে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আমরা এই কমিটির সমালোচনায় বিভিন্ন লেখালেখি দেখতে পাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ঢাবি ছাত্রদলের কমিটি এই মুহূর্তে এত বড় করার দরকার ছিল না। এ ক্ষেত্রে ত্যাগীদের কমিটিতে রেখে এটা একটু ছোট করে নতুনদের আরও কিছুদিন সময় দিলে ভালো হতো। তারা কিছুদিন রাজনীতি করার পর অভিজ্ঞ হলে সে অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করে আনা হলে সেটা ভালো হতো। এই কমিটিতে নতুনদের বেশি ঢোকানো হয়েছে। যার কারণে ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবিরসহ অন্য ছাত্র সংগঠনের লোকদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছি। আর আগে তো আমরা মেয়েদের হলে কমিটিই দিতে পারিনি লোকবলের অভাবে, আর এখন মেয়েদের দুই মাসের ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে।
আরেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, এই কমিটিতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেশকিছু ত্যাগী কর্মী বঞ্চিত হয়েছেন। বেশকিছু সম্ভাবনাময়ী, পরীক্ষিত ও রাজপথে সক্রিয় ছেলেকে নামমাত্র পদ দেওয়া হয়েছে, এটা নিয়ে তাদের মধ্যে মনঃক্ষুণ্নতা সৃষ্টি হয়েছে। গ্রুপিংয়ের কারণে সভাপতি সেক্রেটারি গ্রুপ ছাড়া অন্য গ্রুপগুলো থেকে অনেকেই বাদ পড়েছে।
বর্তমান কমিটির এক সহসভাপতি বলেন, কেন্দ্রীয় ও ঢাবি সভাপতি সেক্রেটারির সঙ্গে যারা রাজনীতি করছে, তাদের সব জায়গায় এগিয়ে রাখা হয়েছে। এর বাইরে গ্রুপভিত্তিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে যে ছেলেগুলো দিনের পর দিন দলের জন্য পরিশ্রম করেছে, তাদের কোনোরকমে একটা পদ দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এবার আমার দেখা পরিশ্রমী এক ডজন ছেলেকে একবারেই বঞ্চিত করা হয়েছে। এমন অনেককেই এনে পদ দেওয়া হয়েছে, যাদের আমরা চিনিই না। এক কথায়, এই কমিটিতে কর্মের মূল্যায়ন যথেষ্ট পরিমাণে হয়নি।
এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, দীর্ঘ দেড় দশকের লড়াই ও দুর্দিনের ত্যাগী নেতাকর্মীদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কমিটি গঠনের চেষ্টা করেছি। একটি কমিটি গঠনের পর আলোচনা-সমালোচনা থাকবেই। তবে কমিটিতে যোগ্যতা অনুযায়ী ত্যাগীদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। সংগঠনের দায়িত্ব পালনে অনেকের ব্যক্তিগত চাহিদা বা প্রত্যাশা থাকে। তবে ছাত্রদলের মতো একটা বৃহৎ সংগঠনে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে সবাইকে খুশি করা সম্ভব হয় না। ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর আমরা সব গ্রুপিংয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সবার মাঝে দায়িত্ব বণ্টনের চেষ্টা করেছি। অনেকে বলছে, নতুন অনেক সদস্য এসেছে, কিন্তু আমি আগেই বলেছি বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে যে ভয়ের সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছিল, সেখানে সবাই একইরকম ভূমিকা পালন করেনি। যার যার অবস্থান থেকে বিভিন্নভাবে আমাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছে। পরিবর্তিত রাজনীতিতে ভয়ের সংস্কৃতি দূর হওয়ার পর তারাই দৃশ্যমান হয়ে শহীদ জিয়ার আদর্শকে ধারণ করে সংগঠনের পতাকাতলে কাজ করতে এসেছে। এজন্য ত্যাগী ও দুর্দিনের নেতাকর্মীদের দায়িত্ব বা পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা একটা স্পষ্ট পার্থক্য রাখার চেষ্টা করেছি। বর্তমান কমিটির মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক কমিটি অতীতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। গ্রুপিংয়ের কারণে কেউ বাদ পড়েছে, এটা একদমই ভিত্তিহীন অভিযোগ।
ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে যত অভিযোগ এসেছে, সেগুলো আমরা আমলে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটির সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী আমরা পরবর্তী পদক্ষেপে যাব।
আপনার মতামত লিখুন :