মহসিন কবির : শেখ হাসিনার পতনে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক সমমনা দলগুলোর ঐক্য সুদৃঢ় রাখার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে আসনভিত্তিক জোট নেতাদের সহযোগিতা করতে ইতোমধ্যে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদেরকে কাছে চিঠি পাঠিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। বিভিন্ন সময়ে এ চিঠিগুলো দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে শরিকদের সহযোগিতার চিঠি নিয়ে বিএনপির তৃণমূলের নোতকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
কেন্দ্রের পাঠানো এই চিঠি নিয়ে বিএনপির তৃণমূলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তিতর্ক মেতে উঠেছেন দলীয় সর্মথকরা। নির্বাচনের ‘কপাল পোড়ার’ আগাম বার্তা পেয়েছেন বিএনপির অনেকেই। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগেই তাদের মনে ক্ষোভের আগুন চলছে। আর এ ঝড় যুগপৎ শরিকদের ফেলেছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নির্বাচনের জন্য নয়, বরং সাংগঠনিক সহায়তার জন্যই এই চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠির ভুল ব্যাখ্যা করে ওইসব নেতা ও তাদের অনুসারীরা মনোনয়ন প্রাপ্তির প্রচারণা চালাচ্ছেন, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
ওই চিঠিতে মিত্র পাঁচটি দলের ৬ শীর্ষ নেতাকে জনসংযোগ এবং তার দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহায়তা করতে নির্বাচনি আসনের থানা, উপজেলা, পৌরসভার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই চিঠির অনুলিপি জোটের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতাদের দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ঢাকা-১২, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর পটুয়াখালী-৩, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ঝিনাইদহ-২ এবং জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাকে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি চিঠিতে ওইসব আসনের থানা-উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির নেতাকর্মীকে জোটনেতাদের সহায়তা করতে বলা হয়েছে।
এসব চিঠির বাইরে ১২ দলীয় জোট নেতা ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমকে মৌখিকভাবে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে কাজ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া ওই এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীকে এ বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
নাগরিক ঐক্যের একজন নেতা জানান, তাদের দলের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসাবে বগুড়া-২ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্যরা জোটগত নির্বাচনে অংশ নিলে এ আসন থেকেই মান্না নির্বাচন করতেন। আগামী দিনেও তিনি এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন। তবে এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না। যে কারণে ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন হত্যা মামলায় স্থানীয় নাগরিক ঐক্যের নেতাকর্মীকে ফাঁসানো হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে কথা বলেন এবং নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
একইভাবে লক্ষ্মীপুরের রামগতি-আলেকজান্ডার এলাকায় বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা আ স ম আবদুর রবের নেতাকর্মীর ওপর হামলা করে আহত করেছেন বলে জানান জেএসডি নেতাকর্মীরা। এ বিষয়েও বিএনপির হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দলটির দপ্তর থেকে ওইসব আসনের স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীকে চিঠি দিয়েছে। যার অনুলিপি জোটনেতাদের দেওয়া হয়।
ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা গণমাধ্যমকে বলেছেন, জেলা বিএনপির সভাপতি এমএ মজিদের বাইরে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে তৃণমূল মেনে নেব না। আবার কাউকে প্রার্থী হিসেবে চাপিয়ে দিলেও ঝিনাইদহের মানুষ মানবে না, বরং প্রতিহত করবে।
সামাজিক মাধ্যমে বিস্ময় প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং পরে দলটির কট্টর সমালোচক গোলাম মওলা রনি লিখেছেন, ‘অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন! মতামত বা মন্তব্য জানতে চেয়েছেন। বাস্তবতা হলো, বিষয়টি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আর এটা নিয়ে আমার কোনো প্রতিক্রিয়াও নেই! বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যা করেন, তা নিজের ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘নুরুল হক নুরু দীর্ঘদিন থেকেই তারেক রহমানের প্রিয়জন এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তি। নুরু গোপনে এবং প্রকাশ্যে বিএনপির জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন। বিএনপি একটি কৃতজ্ঞ দল এবং তারেক রহমানের কৃতজ্ঞতাবোধ সর্বজনবিদিত। সুতরাং তিনি যদি তার দুঃসময়ের সহযোদ্ধা এবং একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত মানুষকে কোনো কিছু দিতে চান, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়!’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, যুগপৎ আন্দোলনের জোট শরিকদের কোনো কোনো নেতাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে চিঠিতে কী লেখা আছে, তা তিনি জানেন না। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমকে বলেছেন, যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলের নেতারা যাতে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন, সেজন্য বিএনপির জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বলে দেওয়া হয়েছে। কারও সঙ্গে যাতে কারও মনোমালিন্য না হয়, সেই লক্ষ্যে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। এটি তো নির্বাচনের মনোনয়ন নয়। সুতরাং এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘আমরা ত্রিমুখীভাবে কাজ করছি। বিএনপি প্রথমে ২৭ দফা সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করেছিল। পরবর্তী সময়ে শরিক সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছি। সেখানে আমরা আন্দোলনরত শরিক দল ও জোট নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনের কথা বলেছি। তাই নির্বাচনের জয়লাভ করুক আর না করুক তাদের জাতীয় সরকারের নিয়ে আসার অনেক পথ রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :