বিবিসি বাংলা : বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি আপাতত স্তিমিত হয়েছে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে। তবে পদত্যাগের এই দাবি একেবারে উবে যায়নি। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-সহ আরও কিছু সংগঠন আপাতত রাস্তায় নেই।
কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে বিষয়টি নিয়ে বঙ্গভবনের সামনে কিংবা অন্য কোথাও বিক্ষোভ বা আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। ‘জনগণের বার্তা’ তারা বুঝতে পেরেছেন।
গত মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং আরও কয়েকটি সংগঠনের সমর্থকরা।
তবে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যায় বুধবার সকালে, যখন বিএনপির প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক করেন।
বিএনপি কী চায়?
প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ।
মি. আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগের মাধ্যমে কোন সাংবিধানিক সংকট এবং রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হোক, সেটা এই মুহূর্তে জাতির কাম্য হতে পারেনা। একই কথা মি. আহমেদ বুধবারও সাংবাদিকদের বলেছিলেন।
‘আমি যা বলেছি সেটা লাউড এন্ড ক্লিয়ার,’ বলছিলেন সালাউদ্দিন আহমেদ।
‘তাতে (রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ) করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের বাধা, বিলম্ব এবং কণ্টকাকীর্ণ হবে সেটা জাতির জন্য কল্যাণকর হবেনা।’
বিএনপি পদত্যাগ চায় কী না? এমন প্রশ্নে নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোন উত্তর দিতে রাজী নন।
বিএনপির একাধিক নেতার সাথে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে তাদের ভেতরেও ‘অস্বস্তি ও আশঙ্কা’ আছে। তারা মনে করেন, মি. সাহাবুউদ্দিন রাষ্ট্রপতির পদ থকে সেরে যাওয়ায়ই উত্তম।
তবে যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেবার কথা হচ্ছিল সেটির সাথে তারা একমত হতে পারেননি।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, রাষ্ট্রপতির বিষয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সাথে আলোচনা করে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা উচিত।
তাছাড়া শুধু রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের করা বড় বড় ইস্যু নয়। এরপর নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন সে বিষয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য দরকার।
এ কারণে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে হুট করে কিংবা তাড়াহুড়ো করে কোন সিদ্ধান্ত নেবার পক্ষে নয় বিএনপি।
বিএনপি নেতাদের সাথে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে কিছু সংশয় আছে। দলটির এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচন।
রাষ্ট্রপতি ইস্যুকে কেন্দ্র কোন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে নির্বাচন নিয়ে বিলম্ব হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য বিষয়টিতে বিএনপি কিছুটা সতর্ক অবস্থানে।
বিএনপি কতটা যৌক্তিক?
রাষ্ট্রপতি ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা কিংবা সাংবিধানিক সংকট তৈরি হলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে বলে বিএনপি যে আশঙ্কা করছে সেটি একবারে অমূলক নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মাহা মির্জা।
রাজনৈতিকভাবে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে বিএনপির দিক থেকে নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা ‘একেবারে বেঠিক’ কিছু না, বলছিলেন মাহা মির্জা।
এর বড় কারণ হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকারের কোন রোডম্যাপ দিচ্ছে না কিংবা দিতে পারছে না। তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে সেটি নিয়ে তাদের কাছ থেকে স্পষ্ট কোন বার্তা পাওয়া যায়নি।
‘নানা ধরণের আশংকা শুধু বিএনপির পক্ষ থেকে না, আমার মনে হয় আমাদের সবার মধ্যেই আছে।’
‘তাদের আসলে কী প্ল্যান? তারা কি এক বছর থাকবে নাকি পাঁচ বছর থাকবে? যে কারণে বিতর্কগুলো আরও রসালোভাবে সামনে আসছে।’
জামায়াতের অবস্থান
গত পাঁচই আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাবার পরে বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক আর আগের মতো নেই।
দুই দলের মধ্যে নির্বাচন ইস্যুতে ভিন্নমত পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুটিতেও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী মনে করে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি যে ‘বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন’ সেটি নিরসনের দায়িত্ব তার নিজের।
‘এই ধরণের বক্তব্য দেবার কারণে তিনি এই মহান দায়িত্বে থাকার নৈতিক ও আইনগত অধিকার হারিয়েছেন। এখন এই পদে থাকার আর কোন সুযোগ আর নেই।’ বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব থেকে চলে গেলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে না বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী।
‘আগে ওনার বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া দরকার। ওনার বিষয়টা পরিষ্কার হলে যেভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে সেভাবেই এই সংকটেরও সমাধান হবে,’ বলেন মি.আকন্দ।
‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিস্টেমও সংবিধানে নাই। কিন্তু সংবিধানে না থাকা সত্ত্বেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে এবং সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স-এর মাধ্যমে সেটি সমাধান হয়েছে। এটা সম্পন্ন হতে পারে। এটা নিয়ে খুব বেশি জটিলতা আমি দেখি না।’
রাষ্ট্রপতির ওপর চাপ প্রয়োগ করে সরিয়ে দেবার বিষয়টিকে জামায়াতে ইসলামী সমর্থন করে কী না?
এমন প্রশ্নে মি. আকন্দ বলেন, ‘এটা চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নাকি স্বাভাবিকভাবে সেটা উনি ঠিক করবেন। আমরা চাই ওনার বক্তব্যের কারণে যে বিভ্রান্তির তৈরি হয়েছে সেটি তিনি নিরসন করবেন।’
সরকার কী বলছে
অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বুধবার বলেন, রাষ্ট্রপতি থাকবেন কি থাকবেন না, এই প্রশ্নটি এই মুহূর্তে কোন আইনি বা সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়। এটি একবারেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
তিনি বেশ পরিষ্কার করেই বলেছিলেন যে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।
‘বিভিন্ন অংশীজনের সাথে আমরা আলোচনা করছি। এবং আলোচনার মাধ্যমে হয়তো একটি সিদ্ধান্ত আসবে। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা। এটি এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি,’ বলেন নাহিদ ইসলাম।
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে রাষ্ট্রপতি ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা হয়।
রাষ্ট্রপতির পদে মো. সাহাবুদ্দিনের থাকা না–থাকার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গত বুধবার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও বলেছিলেন, তারা মনে করছেন এটা রাজনৈতিক আলোচনা সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বৃহস্পতিবার আদালত প্রাঙ্গনে সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে সাংবিধানের আলোকে সমাধান খুঁজতে হবে।
‘শুধু পার্লামেন্টই পারে একজন রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়িয়ে নিয়োগ প্রদান করতে। এছাড়া আর কোন উপায়ে কোন রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগ দান করা সম্ভব না।’
‘ডকট্রিন অব নেসেসিটির নামে যা ইচ্ছা তাই করা যায় না। সেগুলো আইন, সংবিধান ইত্যাদি মেনেই করতে হয়। কথায় কথায় ডকট্রিন অব নেসেসিটি বলা উপহাসের মতো লাগে,’ বলেন মি. করিম।
আপনার মতামত লিখুন :