মহসিন কবির : টানা তিনবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হয়েছেন জাতীয় পার্টি। এজন্য নানা অভিযোগ রয়েছে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। জি এম কাদের ও প্রেসিডিয়াম সদস্য শেরীফা কাদেরের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু বলেছেন, ছাত্র-জনতা বা বিএনপির আন্দোলনে নয়, অতিরিক্ত পাপ করায় শেখ হাসিনার ওপর আল্লাহর গজব পড়েছে। আওয়ামী লীগের চেয়ে জাতীয় পার্টি বড় অপরাধী। কারণ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতে গত ১৬ বছর সহযোগিতা করেছে জাতীয় পার্টি।
নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ক্ষমতায়ও ছিল অনেক বছর।
ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই জাতীয় পার্টির ভূমিকা তুলে ধরে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব মীর আবদুস সবুর বলেছেন, ১ জুলাই ছাত্ররা চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু করলে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ৩ জুলাই সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সামনে ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে বক্তৃতা করেন। যখন আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে আটক করা হলো, জাতীয় পার্টি তাঁদের মুক্তি দাবি করেছিল। ছাত্র আন্দোলনে যখন গুলি চালানো হলো, জাতীয় পার্টি এর প্রতিবাদ করেছে। দুঃখজনকভাবে সেই দলকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।
জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে সম্প্রতি ওঠা অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের তিনটি নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার শাস্তি হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংলাপে ডাকা হয়নি, এমন প্রচারণা জাতীয় পার্টির জন্য বিব্রতকর।
জি এম কাদের বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে, পরামর্শ চাইলে আমরা দেবো। যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, অভিযোগ করা হচ্ছে, সেগুলো ভ্রান্ত, সেগুলো সঠিক নয়। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন আমরা করে আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সেই কারণে তাদের দোসর বলা হচ্ছে।'
টানা তিন বার আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে নির্বাচন করেছে জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগের সব অপকর্মের সাক্ষী ও সঙ্গী তারা এমন অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় পার্টিকে সংলাপে ডাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সমন্বয়করা।
এর মধ্যে জাতীয় পার্টির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ করতে চাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজ নিজ পেজে সোমবার (৭ অক্টোবর) মধ্যরাতে এ বিষয়ে পোস্ট দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
ফেসবুক পোস্টে সারজিস লিখেন, ‘জাতীয় পার্টির মতো মেরুদন্ডহীন ফ্যাসিস্টের দালালদের প্রধান উপদেষ্টা কিভাবে আলোচনায় ডাকে?’। অপরদিকে হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, ‘স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হলে, আমরা সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও কঠোর বিরোধিতা করব।’
১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিশাল জয় পায় দলটি। যদিও দুটি নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও, ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সব বড় দল বর্জন করে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে পতন হয় এরশাদের। তিন মাস পরের নির্বাচনে জাপা ২২১ আসনে প্রার্থী দিয়ে জয় পায় ৩৫ আসনে। নব্বই-পরবর্তী ভোটের রাজনীতিতে এটিই লাঙ্গলের সেরা সাফল্য। ওই নির্বাচনে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের ইসলামীর পর চতুর্থ স্থানে ছিল জাপা। ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পাওয়া লাঙ্গল পায় ৩২ আসন। সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয় জাপা।
পরের বছরের জানুয়ারিতে জামিনে মুক্তি পান এরশাদ। এর আগে প্রায় ছয় বছর টানা কারাগারে ছিলেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। তিনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় জাপার ক্ষণে ক্ষণে পক্ষ বদল। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগকে ছেড়ে বিএনপি জোটে যায় জাপা। পরের বছর জোট ছাড়েন এরশাদ। ২০০১ সালের নির্বাচনে ১৪ আসন এবং ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পায় লাঙ্গল। নীলফামারী-৩ বাদে বাকি ১৩টি আসন ছিল বৃহত্তর রংপুরের।
২০০৬ সালে ফের আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করেন এরশাদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৪৯ আসনে প্রার্থী দেয় দলটি। এর মধ্যে যে ২৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল না, তার ২৭টিতে জয় পায় লাঙ্গল। বাকি ২০ আসনের একটিতে জিততে পারেনি। রংপুরের তিনটি বাদে বাকি ১৭টি আসনে লাঙ্গলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এ পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সফলতা পায় জাপা।
বিএনপিবিহীন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এরশাদ বর্জন করলেও রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাপার একাংশ ভোটে যায়। ওই নির্বাচনে ২২টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। বাকি ৬৬ আসনের ১২টিতে জয় পায় জাপা। ওই নির্বাচনে জাপা যে ৩৪ আসনে জয় পেয়েছিল, তার ৩৩টিতে নৌকার প্রার্থী ছিলেন না। আওয়ামী লীগ ৪২টি আসন ছাড়লেও ৯টিতে স্বতন্ত্র, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির মতো ছোট দলের বিপক্ষে হেরে যায় লাঙ্গল। শুধু ঢাকা-১ আসনে আওয়ামী লীগকে হারিয়েছিল জাপা। গত ২৩ বছরে জাতীয় নির্বাচনে নৌকাকে হারানোর একমাত্র উদাহরণ লাঙ্গলের।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে জাপা ২৩টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল হয়। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের অনেক নাটকীয়তার পর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে আসে দলটি। সেই সমঝোতার ২৬ আসনের মধ্যে মাত্র ১১টিতে জয় পেয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :