গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারী রাজনৈতিক দলকে ১০ বছর নিষিদ্ধের বিধানসহ আটটি সংশোধনীর প্রস্তাব এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের প্রাথমিক খসড়া করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। খসড়ায় এই আইনের অধীনে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধসহ ইত্যাদি অপরাধ হতে পারে এটা জানা সত্ত্বেও যদি কোন সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র বা সত্ত্বার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকেও বিচারের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ, ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক যেন আদালতে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারে খসড়ায় সেই প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। বিচারে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচারের বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) প্রাথমিক খসড়ার উপর মতবিনিময় সভায় অংশ নেন আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজ্ঞ, শিক্ষার্থীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। রাজধানীর বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের মতামত নিয়ে আইনটি সংশোধন করা হবে। তিনি বলেন, অতীতে দেখেছেন, এদেশে বিচারের নামে কি ধরণের অবিচার হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো। তিনি বলেন, আমাদের বুকের ভিতর যত কষ্ট, হতাশা ও ক্ষোভ থাকুক না কেন এই খুনের বিচারকে অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমরা প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার বিচার করতে চাই না। আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই।
শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, সবদিক বিবেচনা করে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আইনে যেসব দুর্বলতা রয়েছে সবার মতামত নিয়ে তা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আশফাক রহমান খসড়া সংশোধনী তুলে ধরেন। প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনীতে ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে ৩টি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে ২টি নতুন উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ধারা ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়।
আইনের ৩ ধারায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় একটি ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণের অংশ হিসাবে গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক যৌনকর্ম ও গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর ফলে জেন্ডার ও কালচারাল গ্রাউন্ডেও যদি কোনো সিভিলিয়ানের উপর ব্যাপক ও সিস্টেম্যাটিক আক্রমণ করা হয় তাহলে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। সব ধরনের ডিজিটাল সাক্ষ্যকে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের ভিডিও স্ট্রিমিং বা অডিও-ভিজুয়াল রেকর্ডিংয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে।
সভায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ বলেন, সংশোধনীর মধ্য দিয়ে আইনটি আরো শক্তিশালী হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এম. আসাদুজ্জামান বলেন, ভিকটিমের পরিবারও যেন আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন সেই সুযোগ আইনে রাখা উচিত। এতে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে।
নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনা উচিত। যদি নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা না হতো তাহলে জুলাই-আগস্টের হত্যাকান্ড সংঘটিত হত না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর এম. তাজুল ইসলাম বলেন, আইনটি এমনভাবে সংশোধন করা উচিত যাতে বিচারের পর দুই পক্ষই মনে করে যেন তারা ন্যায় বিচার পেয়েছেন।
সিনিয়র অ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না বলেন, আমাদের গণবিরোধী আইনগুলো বিলোপ করতে হবে সবার আগে। যদি বিলোপ করা না হয় তাহলে যত পরিশ্রমই করা হোক না কেন তা বিফলে যাবে।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিচারককে গ্রহণযোগ্য করতে ট্রাইব্যুনালে একজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিচারক নিয়োগ করা দরকার। যারা বিচার করবেন তারা যেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকেন। বিচারের মাঝপথে যেন কোন বিচারক সরে না যান।
ব্যারিস্টার জ্যের্তিময় বড়ুয়া বলেন, সকল রকম সাক্ষ্যকে ডিজিটাল সাক্ষ্য এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল এভিডেন্সগুলোর যেন সত্যতা থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
সভায় আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব (চলতি দায়িত্ব) ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও অধ্যাপক নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বেগম আসমা সিদ্দীকা, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী প্রমুখ বক্তব্য দেন। উৎস: ইত্তেফাক।
আপনার মতামত লিখুন :