এম এইচ বাচ্চু : দেশে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রয়েছে। সবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলা হয়েছে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধের বিপক্ষে ছাত্ররা। ছাত্র নেতাদের কেউ কেউ বলছেন এটা ষড়যন্ত্রের অংশ।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে রাজনীতি। এবার সে পথেই হাঁটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও (ঢাবি)। গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের বৈঠকে এ বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্তও নিয়ে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো বলছে, সিন্ডিকেট সভা থেকে নেওয়া ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক। ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সিন্ডিকেট।
ছাত্রনেতারা বলছেন, গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আর ছাত্ররাজনীতি মিলিয়ে ফেলা হবে হঠকারিতা। ছাত্ররাজনীতির সংস্কার হতে পারে তবে একেবারে বন্ধ কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষণা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে ছাত্রদল, শিবির এবং বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা একমত পোষণ করেছেন।
রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। কেউ কেউ বন্ধের পক্ষে আর কেউবা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বাদ দিয়ে নতুন ধারায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ দেশ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিগত ১৬ বছর আপনারা ছাত্রলীগ দেখেছেন। ছাত্ররাজনীতি দেখেননি। ছাত্রলীগের রাজনীতি আর ছাত্ররাজনীতিকে মিলিয়ে ফেলা মারাত্মক হঠকারিতা। রাজনীতি চর্চার সুযোগ ও পদ্ধতি নিয়ে আলাপ হতে পারে। আমার জানামতে, সব সংগঠন তার রাজনীতিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে এবং শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে আরও অনেক পরিবর্তন করতে প্রস্তুত।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেছেন, ‘যে রাজনীতি বিগত ১৬ বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ করেছে, তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ফলে ছাত্রদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে, তারা সন্ত্রাস- দখলদারিত্বকেই ছাত্ররাজনীতি মনে করছে। কিন্তু সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের দায় ছাত্ররাজনীতির নয়। আমরা সবাইকে ভেবে দেখতে বলব ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলেই দখলদারিত্বের অবসান হবে কি?
ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কারও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা সংবিধানের লঙ্ঘন। আমরা সবসময়ই বলেছি ছাত্ররাজনীতির নামে প্রচলিত চর্চা সংস্কার করতে হবে। দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করার প্রতিযোগিতার কারণেই ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতর ভয় এবং নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম নিয়েছে। তা দূর করতে অবশ্যই ছাত্র সংগঠনগুলোকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সেটির জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার ছিল। ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিতভাবে আয়োজন করা দরকার। তা না করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত ছাত্রদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করার শামিল। এটিও ফ্যাসিস্ট আচরণ বলেই আমরা মনে করি।’
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেছেন, ‘ছাত্ররাজনীতি বা রাজনীতি মানুষের মৌলিক বা সাংবিধানিক অধিকার, যার জন্য এই ফ্যাসিবাদ হাসিনার বিরুদ্ধে আমরা দীর্ঘ লড়াইয়ে ছিলাম। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধারণা সেটি সবসময় মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশকে ধারণ করে। সেই জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক। এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো গণতন্ত্রকামী শিক্ষার্থী গ্রহণ করবে না।’
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেছেন, ‘ঢাবির সিনেটের অধিকাংশ সিন্ডিকেট সদস্যরা আওয়ামী সমর্থক এবং তারা বিগত সময়ে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। সেহেতু তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্য লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত জরুরি সিন্ডিকেট সভায় ক্যাম্পাসে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সকল প্রকার রাজনীতি বন্ধ রাখার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত ভুল এবং হঠকারী বলে মন্তব্য করেছেন ডাকসুর সাবেক তিন ভিপি। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, এটা নতুন ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পরিবেশ আরও খারাপ হবে। তরুণ তথা ভবিষৎ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার জায়গা হচ্ছে এই ক্যাম্পাস। সেখানে যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছেন তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তটি বড় ভুল। এতে পরিবেশ আরও খারাপ করে তুলবে। ইতিহাস প্রমাণ করে ছাত্র রাজনীতির ওপরে যখনই নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে, তখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। সেটা আইয়ুব কিংবা ইয়াহিয়ার আমলেই হোক, স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বা জাতীয় পার্টির আমলেই হোক সব সময়ই এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ছাত্র সমাজকে রাজনীতি সচেতন করার জন্য উৎসাহিত করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা রাজনীতি বেশি হওয়ার জন্য নয়, বরং রাজনীতি কম হওয়ার জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
ডাকসুর আরেক সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ সিদ্ধান্তটা কিসের পরিপ্রেক্ষিতে আসছে তা জানি না। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কোনো কারণ নেই। ছাত্র রাজনীতি সব সময়ই আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ভ্যানগার্ড। পত্রিকায় যেটুকু পড়েছি তাতে বলা হচ্ছে লেজুড়বৃত্তি, চাঁদাবাজি, দুর্বৃত্তপরায়ণতার কারণে রাজনীতির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যা দরকার। কারণ দুর্বৃত্ত যদি না থাকে তাহলে সে রাজনীতি করতে পারবে না কেন? সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে, সেটা এ কারণেই যদি হয় সে ব্যাপারেও স্পষ্ট একটি কর্মপদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জানাতে হবে। এটা সবার সামনে উন্মুক্ত করলেই ভালো। তিনি বলেন, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হবে কেন? যদি আমি ছাত্র রাজনীতি পরিশুদ্ধ করতে চাই সারা দেশের ছাত্র রাজনীতি পরিশুদ্ধ করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :