ড্যান মোজেনা : এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, অনেক আগে বাংলাদেশ আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। এক দশক আগে আমি যখন আমার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বের শেষে ঢাকা ত্যাগ করি, তখনকার সেই বেদনাদায়ক দিনটিতে মন্তব্য করেছিলাম- ‘আমি বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার হৃদয় পড়ে থাকলো’। এখনো তেমনই আছে।
যারা বাংলাদেশের প্রতি আমার স্থায়ী ভালোবাসার কথা জানেন, তারা মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন করে জানতে চান- ‘বাংলাদেশের এত বিশেষত্ব কী?’ এই প্রশ্নটির একটি সরল উত্তর আছে। তা হলো- জনগণ, বাংলাদেশের চমৎকার মানুষগুলোই হলো এর কারণ। এ জন্যই আমার কাছে দেশটি এত স্পেশাল। রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় দেশটির পুরো ৬৪টি জেলা সফর করেছি। যেখানেই সফরে গিয়েছি দেখেছি বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ- তার মধ্যে আছেন কৃষক, গ্রামের নারী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, মেডিকেল ওয়ার্কার, রাস্তার হকার, দোকানদার, ব্যবসায়ী, তৈরি পোশাকের শ্রমিকরা- তারা সবাই কঠোর পরিশ্রম করেন। তারা একটি শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, সমৃদ্ধ, সুস্থ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সৃজনশীলতার সঙ্গে কাজ করেন। যা ছিল ‘আন্তর্জাতিকভাবে তলাবিহীন ঝুড়ি’ খ্যাত দেশটির জন্য সুদূরপরাহত। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে নিয়ে ওই মন্তব্য করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিক।
স্বৈরাচারের আবেশ ও নিষ্পেষণে দেশটির জনগণ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। পুরো জাতি হিসেবে এর বিরুদ্ধে গত জুলাই ও আগস্টে বাংলাদেশি জনগণ তাদের ম্যাজিক ও বিস্ময়ের পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শন করেছেন। এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্ররা। তারা সেই ছাত্র, যারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন- যেখানে তাদের নিজেদের, তাদের পরিবারের এবং সম্প্রদায়ের জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ গড়তে নাগরিকরা অবাধে এবং নিরাপদে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এই আশা করাটা কী খুব বেশি? আমি তা মনে করি না। এমনকি শিক্ষার্থীরাও মনে করেন না। তাই তারা নতুন বাংলাদেশের সন্ধানে অবিচল। দুঃখজনক হলো- এই জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে কেউ কেউ আত্মত্যাগ করেছেন।
‘এনাফ’ বা যথেষ্ট হয়েছে- এমনটা ঘোষণা দিয়ে নিষ্পেষণকে দূরে ছুড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম ঘটনা নয়। পূর্বে জনগণ মুক্তির যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তার ইতিটা ভালো হয়নি। কারণ, নিষ্পেষণকারী শক্তির নতুন করে আবির্ভাব হয়েছে এবং আবার জনগণের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। আমি মনে করি, এবার বিষয়টি ভিন্ন হবে। শিক্ষার্থীরা অনুধাবন করতে পেরেছে যে, পূর্বের শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাতেই তাদের কাজ শেষ নয়। এটা হলো একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য তাদের যে বিরাট লক্ষ্য আছে তার একটিমাত্র পদক্ষেপ। ইতিহাস বলে যে, বিপ্লবীরা যখন ক্ষমতায় বিদ্যমান কাঠামোকে উৎখাত করে তাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য অর্জন করে তখন মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়াই শুরু হয়ে যায়। এটা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত যখন একজন নেতা নেতৃত্বের শীর্ষে উঠে না আসেন এবং অন্য নেতারা হারিয়ে যান অথবা তাদের খারাপ কিছু ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা নিয়েছেন এবং একটি ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন। এ জন্য তাদেরকে বড় রকমের কৃতিত্ব দিতে হয়। তাদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে কুস্তি করার পরিবর্তে ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন এবং তাদের এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোকিত মানুষ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। প্রফেসর ইউনূস একজন অনুপ্রেরণাদায়ক বাছাই। তার কোনো ব্যক্তিগত রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। তিনি নিজের জন্য কোনো ক্ষমতা চান না। তাকে আরও প্রমাণ দেয়ার কিছু নেই। এরই মধ্যে তিনি একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। আমি বিশ্বাস করি এই চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য তিনি তার প্রিয় বাংলাদেশের জন্য একটি পথ বের করতে সরলভাবে সহায়তা করছেন।
এই বিপ্লব একটি মুক্ত, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কাছে দীর্ঘদিনের অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক ঐতিহাসিক সুযোগ। যে স্বপ্ন বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত কিন্তু উত্তাল ইতিহাসের দুঃখজনকভাবে বার বার চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে। সামনের পথ অপ্রত্যাশিত বিপদের (ট্রেচারাস)। বাংলাদেশ যখন নিজেকে পুনর্গঠনের জন্য লড়াই করছে, তখন কেউ কেউ চাইছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ব্যর্থ হোক। উগ্রপন্থি এবং অন্যরা তাদের নিজেদের এজেন্ডাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সুযোগ খুঁজছে। অন্যদের মনে ক্ষোভ ও ক্রোধ ভরা। বিগত সরকারের নৃশংসতার বাস্তবায়ন করে বা সুবিধা নিয়েছেন যারা তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে তৎপর তারা।
এই নেতিবাচক শক্তি অস্থিতি সৃষ্টি করছে। তারা এমন এক সময়ে জনগণের মধ্যে ঘৃণাকে এবং বিভক্তিকে গাঢ় করছে যখন বাংলাদেশিদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে একটি টেকসই গণতন্ত্র সৃষ্টির জন্য। যে গণতন্ত্র সব নাগরিকের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। এই লক্ষ্যে একমাত্র পথ খোলা আছে। তা হলো, প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বের অধীনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। আমি আশা করবো এই ক্রান্তিকালে সব বাংলাদেশি এই সরকারকে সহায়তা করে অন্তর্বর্তী এই সরকারের পাশে থাকবেন। এই সরকারকে দেখতে সাহায্য করবেন যে, এটি বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক পথে চালু করার জন্য ঠিক কি করেছে, কোথায় ভুল করেছে এবং কোথায় এটি আরও ভালো করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন সঠিকভাবে করতে পারে।
এবার গণতন্ত্র বিনির্মাণে বাংলাদেশের জয় হবেই নাগরিকদের মধ্যে এই আশা টেকসই করাটা হলো অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারকে বহুবিধ ফ্রন্টে কাজ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে আছে ক) সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খ) মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা সরবরাহ করতে হচ্ছে। গ) দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর অভিযান চালাতে হচ্ছে। ঘ) এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তোলা, যা কর্মসংস্থান এবং জীবনমান উন্নত করবে। ঙ) বিগত সরকারের যারা জনগণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য কাজ করেছে তাদের জবাবদিহিতা করানো। চ) পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা, যারা জনগণের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত কম পদক্ষেপ নিয়েছেন তাদেরকে দক্ষিণ আফ্রিকার মডেল অনুসরণ করে একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়ায় পুনর্বাসন করা। এই প্রক্রিয়ায় এসব ব্যক্তি তাদের অতীতের পাপ সম্পর্কে জনগণের সামনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে, ভিকটিমদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং বাংলাদেশের উদীয়মান গণতন্ত্রের জন্য তাদেরকে প্রতিশ্রুতিশীল থাকতে হবে। চূড়ান্তভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সংস্কার করতে হবে, যাতে বাংলাদেশিরা কার্যকরভাবে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারেন, নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পারেন অথবা বিদ্যমান বিরোধী দলগুলো তাদের নিজেদেরকে নতুন করে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করার মধ্যদিয়ে তা করতে পারে। এমন হলে দলীয় নেতাকর্মীরা অবাধে তাদের দলীয় নেতা বাছাই করতে পারবেন।
এসব চ্যালেঞ্জের গভীরতা এবং তীব্রতার বিষয়ে প্রশংসা করি আমি। তা সত্ত্বেও, আমি বাংলাদেশের জনগণের ওপর আস্থাশীল যে, অন্তর্বর্তী সরকারের অংশীদারিত্বের অধীনে এসব চ্যালেঞ্জের জয় বেরিয়ে আসবে। তাতে নির্বাচনী সংস্কার বেরিয়ে আসবে, যাতে নাগরিকরা অবাধে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন। বাংলাদেশকে শুধু ভালোবাসেন এমন একজনের পক্ষ থেকে এটা কি শুধু ইচ্ছাপূরণের চিন্তা? আমি তা মনে করি না। বাংলাদেশিরা জানেন যে, এটা তাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। তারা তাদের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বহুবার চুরমার হয়ে যেতে দেখেছেন। স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসাকে মেনে নেবেন না বাংলাদেশিরা। তারা গণতন্ত্রের চেয়ে কম কিছুকে মেনে নেবেন না।
(লেখক: বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তার এই লেখাটি অনলাইন দ্য ডেইলি স্টার থেকে অনুবাদ করেছে মানবজমিন।)