মতিউর রহমান চৌধুরী, জনতার চোখ থেকে নেয়া: ক্ষমতার নেশায় পেয়ে বসেছিল শেখ হাসিনাকে। ক্ষমতা আরও ক্ষমতা, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। টানা সাড়ে ১৫ বছর শাসন করেও তিনি ক্লান্ত নন। যে করেই হোক ক্ষমতায় থাকতে হবে। তাই প্রতিবার নির্বাচন এলেই নানা ফন্দি-ফিকির। এক-এগারোর নায়কদের সঙ্গেও সমঝোতা করে ২০০৮ সনে নির্বাচনে জয়ী হন। খালেদা জিয়া এককেন্দ্রিক না হলে অন্য ইতিহাস হতো। কিন্তু খালেদা জিয়া কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতার সঙ্গে আপোষ করতে রাজি নন। শেখ হাসিনা এখানে সুযোগসন্ধানী। একদিকে ভারত। অন্যদিকে জরুরি জমানার শাসকদের সঙ্গে আপোষে যান বিনা শর্তে। এর আগের ইতিহাস বিতর্কিত, অনেকটা নাটকীয়। সাইবার ক্রাইমের মতো। আড়ালে আবডালে অপরাধ করে নিজেকে সহিহ হিসেবে জাহির করা।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য শুরু থেকেই আশ্রয় নেন নানান কৌশলের। বিরোধী মত ও পথকে স্তব্ধ করে দিতে চান। বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটে তারই ধারাবাহিকতায়। প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি যাতে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে না পারে সে জন্য আগাগোড়াই ছিলেন কর্তৃত্ববাদী। ক্ষমতার কাছে নিজেকে আপোষহীন করে তোলেন। বিসর্জন দেন নীতি-নৈতিকতার। বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ে যান হাতের মুঠোয়। একদিন যে ক্ষমতা ছাড়তে হবে- এটা তার অভিধানে ছিল না। কাঁচের পেছনে অন্য ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা তিনি মানতেন না। প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল তার ভেতরে।
যে করেই হোক, বাবার হত্যার বিচার করতে হবে। এজন্য তিনি নিজের দলকে বলি দেন। গড়ে তোলেন একটি বিশেষ বাহিনী। যাদের কাজ ছিল ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা। পরিবার ছিল তার কাছে মুখ্য। চারদিকে মানুষ খুন হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। কিন্তু ভাব দেখাতেন তিনি কিছুই জানেন না। তার অভিনয় ছিল নিখুঁত। নীরব সাক্ষী ছিল জনগণ। দেশ থেকে টাকা বিদেশ যাচ্ছে। তিনি লোক দেখানো তদন্ত কমিটি করতেন। অথচ তার জানামতেই কারবারিরা নানা কৌশলে টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। আখেরে দেখা গেল দেশটা ফোকলা হয়ে গেছে। ক্ষমতা আর টাকা ছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না। শুরুতে অবশ্য দেশটা গড়ার জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু অন্যায়-অবিচার যখন নিত্যদিনের সঙ্গী তখন তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে গেলেন। মিডিয়া সম্পূর্ণ কব্জায়। বুদ্ধিজীবীরা নির্বাক। লোভের কাছে তারা নিজেদের বিকিয়ে দেন। তার শাসনের শুরুটা ছিল আলোচিত এবং রহস্যজনক।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সন পর্যন্ত অন্য এক হাসিনা। সুযোগও ছিল কম। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ছিল না। ২০০১-এর নির্বাচনে হেরে গিয়ে আরও ফুঁসে উঠেন। অবাস্তব কিছু বিষয় সামনে এনে নিজেকে আরও ক্ষমতাপাগল করে তুলেন। কৌশল আঁটেন, অন্য এক শক্তির সঙ্গে আপোষ করেন। তখন দেশ আর জনগণ তার কাছে তুচ্ছ। বিএনপি’র ব্যর্থতার সুযোগে পর্দার আড়ালের শক্তির সঙ্গে যান সমঝোতায়। আর এই সমঝোতা করেন বিদেশে বসেই। সই করেন আসন ভাগাভাগির এক অলিখিত চুক্তিতে। ২০০৮-এর নির্বাচনের নেপথ্যের কারিগররা নিজেদের বাঁচানোর জন্য তৃতীয়পক্ষের দূতিয়ালিতে রাজি হন।
একজন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তার রোজকার ডায়েরি থেকে এ বিষয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে। খালেদা জিয়া জানতে পেরে নির্বাচনমুখী হতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এখানে বাদ সাধেন। বলেন, কী সর্বনাশ, আমরা জয়ী হতে যাচ্ছি। নির্বাচন বয়কট করা হবে মস্ত বড় রাজনৈতিক ভুল। সেনাদের পাতানো ছকে পা দিয়েছিলেন মুজাহিদ। এর কঠিন মূল্য দিয়েছেন জামায়াত নেতারা। মুজাহিদ নিজেও। যুগে যুগে জামায়াত নেতারা এভাবেই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছেন।
খালেদা জিয়া একবার ক্ষমতার স্বাদ দিয়েছিলেন। হাসিনা বিশ্বাস করতেন, ভারত আছে তাই দুনিয়ার আর কাউকে পরোয়া করার দরকার নেই। অথচ পশ্চিমা শক্তি তার শাসন ক্ষমতার শুরুতে সমর্থন যুগিয়ে আসছিল। ভারতও তাকে এমন ধারণাই দিচ্ছিল- তার কাছ থেকে ক্ষমতা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বিরোধী শক্তিকে এমনভাবে ম্যানেজ করা হবে যাতে তারা কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু তারা বলেছিল, কোনো অবস্থাতেই এক দলের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তথাকথিত গণতন্ত্রের লেবাস পরিয়ে দিতে হবে।
হাসিনা তখন বাকশাল না করে অন্য কায়দায় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে উদ্যোগী হন। খালেদাকে জেলে নেন এক সাজানো মামলায়। লন্ডনে তারেক রহমানের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করেন। পর্যায়ক্রমে তিনজন করে গোয়েন্দা কর্মকর্তা লন্ডনেই অবস্থান করতেন। কী মজা! জনগণের টাকা এভাবেই অকাজে ব্যবহৃত হতো। এসব কাজে কতিপয় চিহ্নিত ব্যবসায়ী ছিলেন নেপথ্যের কারিগর। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করতে গিয়ে একটি উগ্র ধর্মীয় শক্তির উত্থানকে সম্ভাব্য করে তোলেন। যার পরিণতিতে দেশটা উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেছে। পশ্চিমা শক্তি এখন বলছে, এত দেখছি আফগানি হাওয়া। রাস্তাঘাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোর দিকে নজর দিলেই আলামত দেখতে পাবেন। গণতন্ত্রহীন দেশে এমনটাই হয়ে থাকে। বিপ্লবের পর মিশরসহ অনেক দেশেই এটা ঘটেছে। উদার গণতান্ত্রিক শক্তি এর কোনো ফায়দা নিতে পারেনি বা ভাগিদার হতে পারেনি। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে এমনটাই দেখা গেছে। ক্ষমতায় না গিয়েও দৃশ্যপটে তারা।
পরিণতিতে হাসিনা নেই, বঙ্গবন্ধুও নেই। একই সঙ্গে গেছে দলও। বাতি জ্বালানোর মতো কেউ নেই ৩২ নম্বরেও। তাহলে বাংলাদেশের সামনে কী অপেক্ষা করছে? ভালো কিছু যে না তা কিন্তু দিবালোকের মতো স্পষ্ট। হাসিনা জেনে বুঝেই এই পরিস্থিতির দিকে দেশকে ঠেলে দিয়েছেন। পাশের বাড়ির আশকারা পেয়ে পশ্চিমা শক্তিকে সকাল-বিকাল গালি দিতে ভুল করেননি। এতে কী হলো? ক্ষমতাও গেল, অঢেল টাকা নিয়ে বিদেশে বসেও শান্তি নেই। কারণ দেশটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। সীমানা বদলের চিন্তায়ও কেউ কেউ বিভোর।
এটা যে এক আত্মঘাতী ভাবনা কে কাকে বলবে? ভাগ্যক্রমে আমরা যে এক জনপ্রিয় দুর্বল সরকার পেয়েছি। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের শেষদিকে চৌদ্দ দলের এক বৈঠকে নেতারা হাসিনাকে বলেছিলেন, শক্ত হাতে দমন করুন। কোনো ছাড় দেবেন না। এই যখন অবস্থা, তখন একজন নেতা বলেন, ক্যান্টনমেন্টের দিকে নজর রাখুন। হাসিনা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও তার চেহারায় চিন্তার ভাঁজ দেখেন নেতারা। ক্ষমতার ভারসাম্য না রাখায় হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। প্রতিশোধের আগুন যে সর্বনাশ ডেকে আনে হাসিনা এখন তা টের পাচ্ছেন। সম্পূর্ণ ভারতনির্ভর হাসিনা যদি বিকল্প কোনো পথ খোলা রাখতেন তাহলে এরকম বিপর্যয় হয়তো আসতো না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে ভারতের জন্য হাসিনা এত কিছু করলেন তারাই কিনা এখন বলছেন, তার মুখের দায়িত্ব নেবে না। কেউ কেউ বলছেন, ভারতকে চেনা বড় কঠিন। দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে যখন টান টান উত্তেজনা তখন তারা বিদেশ সচিবকে ঢাকায় পাঠায়। গোপনে বিদেশ সচিব বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সরকার কি জানতো? কী কথা হলো তাদের মধ্যে? একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, যা সত্য তারই স্বীকৃতি দিয়ে গেল ভারত। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ক্ষমতার ভাগাভাগি চলছে। একদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্যদিকে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ক্ষমতার দুই কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে বিক্রম মিশ্রি ভারসাম্যের কূটনীতির জানান দিয়ে গেলেন মাত্র। এটাই চাণক্য কূটনীতি।
ওদিকে শেখ হাসিনা এখন কী করবেন? দল গোছানো কঠিন। নাকি আরও সময় নেবেন? কাউকে তিনি বিশ্বাস করেন না। এমনকি নিজের ছায়াকেও। তাই বলে কি আওয়ামী লীগ নামের দলটি অস্তিত্ব সংকটেই থাকবে? এই যখন অবস্থা তখন বিদেশ থেকে খবর এলো- অপেক্ষাকৃত তরুণ ৭ জন নেতা দলটি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন। এর মধ্যে পরিবারের একজন সদস্যও রয়েছেন। সেনানিবাসে আশ্রয়রত সবাই যে যার মতো চলে গেলেও এখনো একজন মজুত রয়েছেন, হয়তো ভবিষ্যতের কোনো প্রয়োজনে।
আপনার মতামত লিখুন :