শিরোনাম
◈ ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে সমঝোতা স্বাক্ষর ◈ কাশ্মীর নিয়ে কোনো ছাড় নয়, ১৩ লাখ ভারতীয় সেনাদের ভয় পায় না পাকিস্তান: জেনারেল আসিম মুনির ◈ দেশে প্রথমবার অভ্যন্তরীণ রুটে কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচল শুরু, রপ্তানিতে আসবে গতি ◈ 'টিপকাণ্ড' ঘিরে মানহানির মামলা: ১৬ তারকাকে আসামি করলেন সেই চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য ◈ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জটিলতা বাড়াচ্ছে আরাকান আর্মি, জাতীয় স্বার্থে আলোচনা সম্ভব: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ◈ কৃ‌ষি গু‌চ্ছের বিশ্ব‌বিদ‌্যালয় ও বিষয় পছ‌ন্দের আবেদন শুরু ◈ বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পক্ষে ভারতের যুক্তি: ‘আগে বাংলাদেশ কী করেছে, সেটাও দেখতে হবে’ ◈ কূটনীতিকের কাছে ৫ মিলিয়ন ডলার দাবি করেন মডেল মেঘনা: চার্জশিটে অভিযোগ ◈ মালয়েশিয়ায় বড় ধরনের অভিযান: ১৬৫ বাংলাদেশিসহ ৫০৬ অবৈধ অভিবাসী আটক ◈ দীর্ঘ বিরতির পর ঢাকা-ইসলামাবাদে সচিব পর্যায়ের বৈঠক, শিক্ষা-বাণিজ্যসহ নানা খাতে সহযোগিতার অঙ্গীকার

প্রকাশিত : ১৭ নভেম্বর, ২০২৪, ০৬:৪৭ বিকাল
আপডেট : ১৮ এপ্রিল, ২০২৫, ০৪:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

একাকিত্ব : আমাদের সমাজে এখন এক বড় অসুখ

মৌলি আজাদ :৬ সেপ্টেম্বর মা হারিয়েছি। বাসার মানুষ ছিলাম মাত্র চারজন। তার মধ্যে একজনের অনুপস্থিতি বাসাকে মুহূর্তে খালি, পরিত্যক্ত বা মরুভূমিতে পরিণত করেছে যেন। প্রথম প্রথম বলতে গেলে বাসা থেকে পালিয়ে বেড়াতাম। বাসার কাছের দোকানপাটে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতাম। মা থাকতে যেই ভরা ঘর ছিল, তা যেন আজ শূন্য। একাকিত্ব এতদিন বুঝতে পারিনি। অন্যদের একাকিত্ব দেখেছি, কিন্তু নিজে বিদ্ধ হইনি। এরপর আরও অনেকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললাম যারা সম্পূর্ণ একা জীবনযাপন করছেন। অর্থ-সম্পদের হয়তো খামতি নেই তাদের কিন্তু একাকিত্ব (একেকজনের একেক রকম) তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। জানলাম, হঠাৎ করে নিঃসঙ্গ হওয়ার পর কতটা যুদ্ধ করে তারা টিকে আছেন। বিদেশে একা জীবনযাপন খুব বেশি স্বাভাবিক। হয়তো তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি আলাদা। কিন্তু আমরা ইমোশনাল বাঙালি। আমাদের জন্য যে কোনো বিচ্ছেদ কষ্টের। তাই একা জীবনযাপনেও আমরা অভ্যস্ত নই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের ঘটনা ঘটার আগে আমরা তা কতটা উপলব্ধি করতে পারি। একা জীবনযাপনে প্রস্তুত কিনা তা নিয়ে আগেভাগে ভাবি কি? আজকাল আমরা যত না ঘরের মানুষগুলোর সঙ্গে মিশি-কথাবার্তা বলি তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকি মোবাইল ফোনে। ঢাকা শহরে এখন সবাই নিজেকে নিয়ে যার যার কাজে ব্যস্ত। কেউ কাউকে নিয়ে ভাবছে না। উপকার তেমন একটা করতে না পারলেও একজন আরেক জনের ক্ষতি করছে। কদিনের জীবন? ক্ষণিকের এ জীবনে সবাই ছুটে চলছি কেবল। পাওয়ার যেন কোনো শেষ নেই। কিন্তু এর শেষ কোথায়? কর্মজীবন পর্যন্ত ছোটাছুটি কিন্তু তারপর? ৬০-৬৫ যে যত বয়সে রিটায়ারমেন্টে যান না কেন, অবসর জীবনটা বেশিরভাগ মানুষের আজকাল একদম একা কাটাতে হয়। আজকাল বেশিরভাগ দম্পতির সন্তান এক দুই জন। তারাও বেশিরভাগ দেশের বাইরে থাকে। যেসব দম্পতি দীর্ঘজীবী হন তাদের হয়তো ভালো-মন্দভাবে জীবন কেটে যায়। কিন্তু যারা সৌভাগ্যবান নন, তাদের কী হয়? কজন আমাদের দেশে বয়স্ককালে প্রাণ খুলে হাসতে পারছেন? টাকা-পয়সা বিত্তবৈভব থাকা সত্ত্বেও আজকাল মধ্যবয়সের পর সবাই কেন একা?

এজন্য নিজেদের কি কখনো প্রশ্নের মুখোমুখি করেছি? এই আমাদের জেনারেশনই তো প্রথম নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি তৈরি করেছি। বৃদ্ধদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছি। ক্যারিয়ারের স্বার্থে সন্তানও নিয়েছি কম। নিজেকে যেমন সময় দেইনি। তেমনি গড়ে তুলিনি কোনো চমৎকার ফ্রেন্ড সার্কেল। ঘুরেছি স্বার্থের জন্য এর ওর পেছনে। হয়তো তারাও আমাদের ব্যবহার করেছেন তাদের স্বার্থেই। নিজেকে সময় না দেওয়ায় হয়েছি নানান রোগে আক্রান্ত। চারপাশের হাজারো উটকো হ্যাসেল আমাদের মাথাকে করেছে হ্যাং। সময় করে পড়া হয়ে ওঠেনি দেশ-বিদেশের নানান বিখ্যাত লেখা। সিনেমা দেখেছি, কতটা পুরোপুরি। কতটা ভাসা ভাসা। অস্থির সময়ের সঙ্গে নিজেও হয়েছি অস্থির। সবকিছু থেকেও যেন আমরা শূন্য।

ধারণা ছিল হাইক্লাস আমরাই বোধহয় এমনটা আছি। কই নাতো? আজ বস্তির রহিমা করিমাদেরও সন্তান দুজনের বেশি নেই। খাওয়ানো পরানোর চিন্তা তো মাথায় তাদের। ছেলেপুলে বড় হয়ে তারা বিদেশ পাড়ি না জমালেও মা-বাবার কাছে আছে। মা-বাবাকে সাহায্য করছে এমনটা দিন দিন যেন কমছেই। আগে ঘরের ছেলেটি যতটা মা-বাবার প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত থাকত, আজ নাকি তাদের মধ্যে সে প্রবণতা নেই। তা অস্বাভাবিক ভাবার কারণ নেই অবশ্য। তারা তো এই সমাজের বাইরে কেউ নয়। বাঙালি পরশ্রীকাতর তা ছেলে-বুড়ো সবাই জানে। ধারণা ছিল, অশিক্ষিত যারা তাদের মধ্যে এই বোধ প্রবল। কিন্তু ইদানীং এই ভুল ভাঙছে। শহরের বড় অফিসের কর্তাব্যক্তিরাও একেকজন যেন হিংসার দলা। কারও ভালো দেখলে যেন শরীর পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। তাই ছড়ায় নিন্দা আর মানুষ নামটা হয়ে যায় কলঙ্কিত। অন্যকে অশান্তিতে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে নিজেও হারিয়ে ফেলছে শান্তি। কি লাভ এতে!

এসব করে করেই আমরা হয়ে যাচ্ছি নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর। এমনিতেই বাঙালি জীবনে মধ্যবয়সের পর ঘরের মানুষই ঘরের মানুষকে মূল্যায়ন করে না, সেখানে বাইরের বন্ধু মানুষগুলোকে তাড়িয়ে দিচ্ছি। তাহলে নিঃসঙ্গ হব নাতো কী হব?

দিনকাল যেহেতু এমনই পড়েছে- তাই আগে থেকেই আমাদের নিঃসঙ্গতা মোকাবিলায় সচেতন হওয়া দরকার।

কী করতে হবে জানুন

-প্রচুর সমমনা মানুষের সঙ্গে গ্রুপ তৈরি করতে হবে।

-জয়েন ফ্যামিলিতে ফিরে যাওয়া যেতে পারে।

-বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ডিং দৃঢ় করতে হবে।

-বাচ্চাদের জন্য মা-বাবা নন, বাচ্চাদেরও মা-বাবার একাকিত্বে সঙ্গী হওয়ার জন্য বোঝাতে হবে।

-দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোও উন্নত করার জন্য পরিকল্পনা করা।

-নিজের শরীরের দিকে মধ্যবয়স থেকে যত্ন নিতে হবে।

-কারও ওপর মাত্রাতিরিক্ত ডিপেন্ড না করার অভ্যাস করতে হবে।

-বাস্তববাদী হওয়া।

-বেশ আগে থেকেই জীবনের এক পর্যায়ে একা হয়ে যেতে হতে পারে আপনাকে- এ বিষয়ে প্ল্যান রাখা।

-একা ঘোরা, একা সব কাজ করার প্রস্তুতি রাখা।

-জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান, বিষয়টি মাথায় রাখা।

-সব সমস্যা নিয়ে মাথা না ঘামানো।

-বাচ্চাদের আপনার একাকিত্বের কথা জানানো। আমাদের সমাজে যা সাধারণত আমরা বাচ্চাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই না। আজকালকার বাচ্চারা অনেক স্মার্ট। তারা জানে অধিকাংশ সময় তারা যেহেতু মা-বাবাকে সময় দিতে পারে না তাই মা-বাবার জীবনে কেউ আসলে তাতে তাদের আপত্তি থাকে না। মূলত কারও জীবন বিবর্ণ করার কারও অধিকার নেই।

-একাকিত্বকে বরণ না করে বেশকিছু একটিভিজে অংশগ্রহণ করা ।

-জীবন একটাই, এটার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

কী চাকরির পরীক্ষা, বিয়ে-শাদি সবকিছুতেই আমাদের প্রস্তুতি থাকে, কিন্তু জীবনে এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আগে আমরা বলতে গেলে একাকিত্ব বিষয়টাকে নিয়ে ভাবিই না। যুগটা এমন পড়েছে যে কেউ কারও না। আমাদের দরকার এ বিষয়ে ব্যাপক কাউন্সিলিং করা। অন্য দেশে বিভিন্নভাবে একাকিত্বে থাকা মানুষকে নানাভাবে হয়তো সাহায্য করা হয় কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্র এখনও এ বিষয়টি তেমনভাবে দেখছে না। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যখন একাকিত্বও মহামারীর মতো রূপ ধারণ করবে তখন হয়তো রাষ্ট্র সমাজ থেকেও মানুষ সাপোর্ট পাবে। তার আগে ব্যক্তিরই সচেতন হয়ে একাকিত্বকে মোকাবিলা করতে হবে।

মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়