বাংলাদেশে একসময় কাগুজে নোটে চিত্রা হরিণ ও দোয়েল পাখির ছবি ছিল। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত হরিণের ছবিওয়ালা এক টাকার কাগুজে নোট প্রচলিত ছিল এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই টাকার কাগুজে নোটে দোয়েল পাখির ছবি ছিল। তবে এখন আর আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো টাকায় বন্যপ্রাণীর ছবি নেই।
কোনো দেশের সূচনালগ্ন থেকেই তার আত্মপরিচয়ের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে দেশটিতে প্রচলিত মুদ্রা বা টাকা। কাগজের নোট ও কয়েনে আমরা বিভিন্ন প্রতীক, লেখা ও ছবি দেখে থাকি।
তবে নান্দনিক মূল্যের বাইরেও এই বাহনটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের মানুষদের মধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সচেতনতা বাড়াতে এবং মানুষ-বন্যপ্রাণী সম্পর্ক ধরে রাখতে জনপ্রিয় ও কার্যকর মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা আমায় ভাবিয়ে তুলেছে, এই উপায় অবলম্বন করে বাংলাদেশ কীভাবে উপকৃত হতে পারে।
আমি কয়েন ও টাকা সংগ্রহ করে রাখার ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী নই। তবে আমি বিশ্বের নিউমিসম্যাটিকসের (কয়েন ও টাকা সংগ্রহবিষয়ক বিদ্যা) জগতে কী ঘটছে, তার ওপর নজর রাখি। বিষয়টিতে আমার আগ্রহ প্রবল হয়, যখন জানতে পারি আবখাজিয়া প্রজাতন্ত্র গত বছর ১০টির মতো ব্যাংকনোট প্রচলন করেছে। এসব ব্যাংকনোটের অত্যাশ্চর্য নকশা, প্রাণবন্ত রঙ এবং এতে অঙিঙ্কত ককেশীয় চিতাবাঘ; সত্যিই আমার নজর কেড়েছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে প্রাণীর ছবিওয়ালা টাকার ব্যাপারে আমার আগ্রহ জাগে।
তবে আমি দ্রুতই বুঝতে পারলাম টাকা সংগ্রহের কাজটি মোটেও সহজ নয়। মুদ্রাসংক্রান্ত অধ্যয়নের সিংহভাগ এমন কিছু থিমের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এমনকি আমার বন্ধুরা আমাকে এর পরিবর্তে আরও আকর্ষণীয় কিছু সংগ্রহের কথা বললেন।
ঘটনাচক্রে আমি গত জুলাইয়ে প্রকাশিত একটি অসাধারণ গষেণাপত্র পেলাম। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিফ ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এতে অবদান রাখেন, যা ব্রিটিশ ইকোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নাল 'পিপল অ্যান্ড নেচার'-এ প্রকাশিত হয়। টাকায় বন্যপ্রাণীর ছবি নিয়ে এটি প্রথম কোনো গবেষণা।
ওই গবেষণায় গবেষকরা ২০৭ দেশের সাড়ে চার হাজার নোট পর্যালোচনা করেন এবং তারা দেখতে পান, প্রতি ছয়টির একটিতে দেশীয় বন্যপ্রাণীর ছবি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুকিতে রয়েছে অথবা কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায়ই শুধু পাওয়া যায় এবং নোটগুলোয় ছবি তুলে ধরার মাধ্যমে ওইসব প্রাণীর গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। ট্রপিক্যাল তথা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয় এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়, যা প্রাণীর বৈচিত্র্য নির্দেশ করছে। গবেষণাটিতে ১৯৮০ থেকে ২০০৭ সালে ইস্যুকৃত ব্যাংকনোটে পোকামকড়, কীটপতঙ্গ, সরিসৃপ ও মাছের পাশাপাশি ১৯৫টি পাখি এবং ৯৬টি স্তন্যপায়ী প্রাণীকে চিত্রিত করার বিষয়টি উঠে আসে।
ব্যাংকনোট প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের হাত বদল হয়, তাই এটি একটি শক্তিশালী বার্তাবাহক। টাকায় বন্যপ্রাণীর ছবি প্রদর্শন; কোনো জাতির ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলার স্মারক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, চীনা নোটগুলোতে জায়ান্ট পান্ডা বা ব্রাজিলিয়ান নোটগুলোতে জাগুয়ারের মতো জাতীয় ঐতিহ্য এবং সংরক্ষণের বিষয়টি প্রতিফলিত করে। বাহামার মতো দ্বীপ দেশগুলো সোর্ডফিশ ও মার্লিনকে গুরুত্ব দেয়, যা পর্যটক আকর্ষণ করে, রাজস্ব আয় করে এবং দীর্ঘদিনের জাতীয় প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল, বন্যপ্রাণীর ছবি সংবলিত মুদ্রা থাকা অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। এখানে বিভিন্ন প্রকারের বন্যপ্রাণীর ছবি ও প্রতীক সম্বলিত মুদ্রা রয়েছে, যা এই দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং পরিবেশ সচেতনতা তুলে ধরে।
বাংলাদেশে একসময় কাগুজে নোটে চিত্রা হরিণ ও দোয়েল পাখির ছবি ছিল। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত হরিণের ছবিওয়ালা এক টাকার কাগুজে নোট প্রচলিত ছিল এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই টাকার কাগুজে নোটে দোয়েল পাখির ছবি ছিল। তবে এখন আর আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো টাকায় বন্যপ্রাণীর ছবি নেই।
এই অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় আমাদের টাকাকে নতুনভাবে ডিজাইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা কি নতুন নোটে বাঘ, মাছ ধরার বিড়াল, হাতি বা শীতকালীন পাখি দেখতে পাব?
বন্যপ্রাণীদের জনসাধারণের কাছাকাছি আনাটা, প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে। উৎস: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
আপনার মতামত লিখুন :