গরীব নেওয়াজ: দশ হাজার বছর বনাম দুই শ বছর পূর্বের পর্বগুলোতে দেখিয়েছি, চল্লিশ লক্ষ বছর পূর্বে মানব সমাজের উদ্ভব হওয়ার পর বাইশ লক্ষ বছর ছিল বন্যদশার নিম্নস্তর। সে স্তরে নারী পুরুষ সবাই বনজঙ্গল হতে নিজ-নিজ খাদ্য সংগ্রহ করে খেত এবং বিবাহ নামক কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কারও অধীনস্থ না থাকায় নারী ছিল স্বাধীন। এরপর এখন থেকে আঠারো হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত আরও কয়েকটি স্তর পার হয়। এসব স্তরে মানুষ আগুনের ব্যবহার এবং শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। মেয়েরা শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেভাবে শিকারে অংশ নিতে পারেনি। তারা গৃহস্থালি ও শিশুপালনে আটকে যায় এবং খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রথমটায় এক রক্তসম্পর্কীয় পরিবার এবং পরে সমষ্টি বিবাহের পুনালিয়া পরিবারে আবদ্ধ হওয়ায় তাদের যৌনজীবন কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব স্তরে মেয়েদের স্বাধীনতা খুব বেশি না হলেও বেশ কিছুটা সংকুচিত হয়। আঠারো হাজার বছর পূর্বে বর্বরদশার মধ্যস্তর শুরু হয়ে তা দশ হাজার বছর তা স্থায়ী হয়। এ স্তরে মেয়েরা চাষ এবং পশুপালনের উদ্ভব ঘটায়। তাদের উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার তাদের শারীরিক শক্তির জন্য যথেষ্ট ছিল। এসময় অস্থায়ী যুগল জোড়াবাঁধা পরিবার সৃষ্টি হয়। নারী যতক্ষণ প্রয়োজন মনে করত ততক্ষণ পরিবার টিকিয়ে রাখত। যেকোনো সময় পুরুষকে বিদায় করে দিতে পারত। নারীর করুণা সাপেক্ষে অনিশ্চয়তায় ভরপুর ছিল পুরুষের জীবন।
সেটা ছিল সম্পূর্ণ নারীশাসিত সমাজ। বর্বরদশার মধ্যস্তরের শেষদিকে লাঙল আবিষ্কার হয়। পরে লাঙলে যখন ষাঁড় জুড়ে দেওয়া হয় তখন শারীরিক শক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে মেয়েরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হতে পিছিয়ে পড়তে থাকে। এরপর দাসযুগ শুরু হওয়ায় এবং জোড়াবাঁধা পরিবারের অভিজ্ঞতায় সন্তান জন্মদানে পুরুষের ভূমিকার কথা জেনে যাওয়ায় নারী গৃহবন্দি হয়ে এক পতিতে আটকে যায়। সমস্ত বর্বরদশার উচ্চস্তর ও সভ্যদশায় নারী অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হয়। পূর্বের পর্বগুলোতে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এরপর আবার কীভাবে নারী মুক্তির পথে হাঁটা শুরু করে তা দেখা যাক। শিল্পবিপ্লব কোনো ব্যবস্থাই চিরন্তন নয়। সবকিছুই নিয়ত পরিবর্তনশীল। যে যন্ত্রের ব্যবহার ও সম্পদ বৃদ্ধি নারীকে অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবন থেকে বিযুক্ত করে, পরিবারে গুরুত্বহীন করে, সচেতনতার নিম্নস্তরে নিয়ে গিয়ে দুর্বিষহ জীবনে নিপতিত করে—সেই যন্ত্রেরই ক্রম-উৎকর্ষতা এবং সম্পদের অধিকতর বৃদ্ধি তাকে মুক্তির পথে ফিরিয়ে আনতে থাকে, সমাজ-জীবনে ফিরিয়ে আনতে শুরু করে এবং চেতনার স্তর বৃদ্ধি করতে থাকে। শিল্পবিপ্লবের ফলে নারীরা উৎপাদনী শ্রমে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে অর্থনৈতিক ভিত্তি অর্জন করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে নারীরা ধীরে-ধীরে পুরুষের জগতে ঢুকতে শুরু করে। যেহেতু শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধি একা পুরুষ যা যোগান দিতে পারে, তার চেয়ে বৃহত্তর শ্রমশক্তির চাহিদা সৃষ্টি করছিল, তাই নারীর সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যন্ত্রই এই উত্থান সম্ভব করেছিল, কারণ পুরুষ ও নারীর মধ্যে শারীরিক শক্তির পার্থক্য যথেষ্টভাবে গুরুত্ব হারায়।
প্রাক-শিল্পযুগের বিপরীতক্রমে উৎপাদনে ইউনিট হিসেবে পরিবার নয়, বরং উপার্জনকারী ব্যক্তি গুরুত্ব পায়। নারী এখন শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায়, ঘর থেকে বেরিয়ে আসায় তার নিজস্ব অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। শিল্প-সভ্যতার দ্রুত বিকাশের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পদের কাছে ভূমি--যার মাধ্যমে স্বামী ও পরিবারের সঙ্গে নারী দৃঢ়ভাবে বন্ধনে আবদ্ধ ছিল—তা গুরুত্ব হারায় এবং পরিবারের দৃঢ়-ঐক্যের নীতিটি তার শক্তি হারায়। এভাবে ব্যক্তি দল থেকে মুক্তি পেতে থাকে। এককথায় বলা যায়, শিল্পবিপ্লব নারীমুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় আর্থ-প্রযুক্তি উপকরণ ও বস্তুসম্পদ যুগিয়েছে। নারীও ধীরে-ধীরে সমাজ-জীবনে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে ও সচেতনতার স্তর বৃদ্ধি করে চলেছে। আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যে শিল্প ও নগরায়ন প্রক্রিয়াটি জোরদার হয়। নারী-পুরুষ নতুন অর্থনৈতিক বিধান মেনে নিতে বাধ্য হয়। ক্রমবর্ধমান হারে মেয়েরা শিক্ষিত হতে থাকে। অন্যদিকে রেনেসাঁর মানবতাবাদে প্রভাবিত হয়ে নারীর মানসিক সামর্থ্য ও মনীষার প্রশ্নে বহু বিদগ্ধ পণ্ডিত-ব্যক্তির মাঝে অধিকতর আলোকপ্রাপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। তাঁরা দেখাতে চেষ্টা করেন নারীরা মানুষ, তাঁরা নারীর ভাগ্যের অবিচারকে নিন্দা করেন। অবশ্য অনেক দার্শনিক, লেখক ও বিজ্ঞানী নারীর অধস্তন অবস্থান দেখানোরও চেষ্টা করেন। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যদিও বাস্তবে নারীর অর্জন খুব সামান্যই, তবুও তা তাদের মুক্তির পথ উন্মোচিত করে। ইতিহাসের অগ্রগতি এইসব একগুঁয়ে প্রতিবন্ধকতা দিয়ে স্তব্ধ করা যায়নি। উনিশ শতকে পশ্চিমা বিশ্বে শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটে এবং প্রসার লাভ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
এর প্রভাবে কল-কারখানায় নারী-শ্রমিকের অংশগ্রহণ খুবই বৃদ্ধি পায়। মধ্য ও উচ্চ বিত্তের নারীরা দ্রুত হারে শিক্ষিত হয়ে উঠতে থাকে। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নারীবাদী সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে এবং তারা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। বিভিন্ন লেখকের লেখা এসব আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি প্রস্তুত করতে থাকে। এমনকি আমাদের এ অঞ্চলও যা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল, সেখানেও নারীরা একের পর এক অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে থাকে এবং তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হতে থাকে। বিশ শতকে এসে নারী আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। বিশ শতকের শুরু হতে কাজের পরিবেশ, শ্রমের সম-মজুরি, ভোটের অধিকার ইত্যাদি দাবি নিয়ে নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম বিকশিত হতে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে নারী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই দুই শ বছরে নারীর যে অর্জন তা আগের দশ হাজার বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এক বিপ্লবী অর্জন। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কোনো ক্ষেত্রই আজ আর এককভাবে পুরুষের জগৎ নয়। পুরুষের এমন কোনো অঙ্গন নেই, যেখানে নারীরা প্রবেশ করেনি। অনেক ক্ষেত্রে সম-অধিকার অর্জন করেছে বা করার পথে রয়েছে, কোনো-কোনো ক্ষেত্রে আবার ছাড়িয়েও গিয়েছে। অবশ্য এখনো তাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। এ পর্যন্তকার সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনায় আমরা দেখতে পেলাম: বন্যদশার নিম্নস্তরে নারী ছিল স্বাধীন, বন্যদশার মধ্য ও উচ্চস্তর এবং বর্বরদশার নিম্নস্তরে নারীর অবস্থান ক্রমশ বেশ কিছুটা অবনত হয়, বর্বরদশার মধ্যস্তরে নারী সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয় নারীর করুণা সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায় পুরুষের জীবন। আর বর্বরদশার উচ্চস্তরে নারীর অবস্থান চরমভাবে পদানত হয় এবং সভ্যতায় তা আরও প্রকট হয়। মাত্র দুই শ বছর হলো নারী আবার মুক্তির পথে হাঁটা শুরু করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিভিন্ন সময়ে এধরনের ভিন্ন-ভিন্ন অবস্থা সৃষ্টি হয়? আর নারী এগিয়ে কতদূর যেতে পারবে, তারা কি সমঅধিকার অর্জন করতে পারবে, নাকি তারা আর একবার পুরুষকে ছাড়িয়ে যাবে? ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :