শিরোনাম
◈ আমাদের পরামর্শ হয়তো আর দরকার নেই, এজন্য ডাকেনি : মুজিবুল হক চুন্নু ◈ পরামর্শ ইতিবাচকভাবে নিয়েছে সরকার: বৈঠক শেষে গণফোরাম ◈ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের প্রেসক্লাবের সামনে মারধর ◈ পলাতক পুলিশ সদস্যরা এখন ‘সন্ত্রাসী’ বিবেচিত হবে, দেখামাত্রই গ্রেফতার : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ◈ দুই মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার দেনা পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক (ভিডিও) ◈ প্রয়োজনে সিস্টেম ভেঙে নতুন লোক বসাবো : উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ (ভিডিও) ◈ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ: এবারও ডাক পায়নি জাপা ◈ নেতানিয়াহুর বাসভবনে ড্রোন হামলা, বেঁচে গেলেন অল্পের জন্য ◈ সিনওয়ারের মরদেহ নিয়ে ‘দর কষাকষি’ করতে চায় ইসরায়েল ◈ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন : সাড়ে চারশ কোটি টাকার ময়লা-বাণিজ্য হাত বদল

প্রকাশিত : ২৮ জুলাই, ২০২৪, ০৩:৪৫ রাত
আপডেট : ১৮ অক্টোবর, ২০২৪, ০৪:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও লেখক স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখেন আসন্ন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের 

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান: তথ্যের বাইরে কেটেছে কিছু দিন। অনেকটা শৈশবের মতো, যখন ছিল না কোনো টেলিভিশন, কোনো রেডিও, কোনো সংবাদপত্র কিংবা কোনো সোশ্যাল মিডিয়া। নির্ভর করতে হয়েছে ফোন এবং পরদিনের সংবাদপত্রের ওপর। তথ্যপ্রবাহ সার্বক্ষণিক বন্ধ থাকায় প্রবল প্রতাপে ডানা মেলেছে গুজব। গুজব-অধিপতি তার সৈন্যদের নামিয়ে দিয়েছে কাতারে কাতারে। মানুষ সম্পূর্ণরূপে কোণঠাসা হয়েছে গুজবের কাছে। যে কোনো সংকটে গুজব থাকে। থাকবেই। এটাই গুজবের কাজ, এটাই গুজবের ধর্ম। একটা মহা সংকট অতিক্রম করল দেশ। একটা মহাদুর্যোগ অতিক্রম করছে দেশ। দুর্যোগ আসাটা অস্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক। প্রকৃতিতে বসন্তের পর খরা আসে, খরার পর বর্ষা আসে, বর্ষার পর শীত আসে। কোনো কিছুই একরকমভাবে চলে না। প্রকৃতির পরিবর্তন যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনি অবশ্যম্ভাবী সব কিছুর পরিবর্তন। যে দুর্যোগ আমরা অতিক্রম করেছি বা করছি, তা স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্যোগ। এই দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো প্রাকপ্রস্তুতি ছিল না। দুর্যোগ যে আসছে, আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম, স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা সতর্ক হইনি, সাবধান হইনি। আমরা হয়েছি উদ্ধত। আমরা হয়েছি দাম্ভিক। আর আমরা হয়েছি বহুধা বিভক্ত। 

একপক্ষ দুর্যোগকে আহ্বান করেছি, আরেক পক্ষ দুর্যোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করেছি এবং আরেক পক্ষ নিরাপদ দূরত্বে বসে দুর্যোগ উদযাপন করেছি। আমাদের বিভক্তি এতটাই প্রকট হয়েছে যে, আমরা কেউ শান্তির পক্ষে অবস্থান করতে পারিনি। শান্তিকে সুদূরে নির্বাসন দিয়ে আমরা ঘোষণা করেছি, হয় তুমি আমার পক্ষে কথা বলো, নয় বুঝে নেব তুমি আমার শত্রু। ফলে শান্তি উধাও হলো। শান্তির অনুপস্থিতিতে কী হলো? হলো ভয়াবহ রক্তপাত, হলো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। পক্ষ-বিপক্ষ থাকবেই। থাকাটা স্বাভাবিক। পক্ষ থাকলে বিপক্ষ না থাকাটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু কাউকে কাউকে দাঁড়াতে হয় শান্তির পক্ষে। কেননা পক্ষ যেমন ভুল করে, বিপক্ষও করে। একটা দেশের সরকার কি ভুল করে না? নিশ্চিতভাবেই করে। সরকার তো আর কিছু নয়, শাসনদণ্ডধারী মানুষেরই একটি গোষ্ঠী মাত্র। মানুষ মাত্রেই ভুল করে। যে মানুষ দাবি করে আমি কোনো ভুল করি না, সে মানুষ নয়। হয় সে শয়তান, নয় সে ফেরেশতা। শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের কি ভুল নেই? আছে, অজস্র ভুল আছে। কিন্তু সেই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো বিরোধী দল নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা আবশ্যক, যাতে তারা সরকারের ভুলগুলোর বিরোধিতা করতে পারে, যাতে তারা সরকারের কঠোর সমালোচকের ভূমিকা পালন করতে পারে, যাতে তারা সরকারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।

কিন্তু মর্মান্তিকভাবে এই দেশের সংসদে শক্তিমান কোনো বিরোধী দল নেই। কেন নেই, তার পেছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস, আছে সুনির্দিষ্ট বিস্তর কারণ। একটা দেশে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি থাকতে হয়, যারা ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, জনগণের হয়ে ক্ষমতাসীনদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবে। আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী কি নেই? আছে, অবশ্যই আছে। কবি লেখক শিক্ষক সাংবাদিক সংস্কৃতিকর্মী আছে। কিন্তু তারা বহুধা বিভক্ত। একদল আছে যারা সরকারের সমালোচক নয়, নিন্দুক। সরকারের মিত্র নয়, শত্রু। তারা সরকারকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করার জন্য কোনো বুদ্ধি-পরামর্শ দেয় না। তারা চায় সরকারের পতন। এখন, এই মুহূর্তে পতন। যার ফলে সরকার তাদের কথা কর্ণপাত করে না। সরকার ধরেই নিয়েছে তারা শত্রুপক্ষ, তাদের কথায় কর্ণপাত করা যাবে না। সরকার ভাবে না, পক্ষ থাকলে যে বিপক্ষও থাকবে। বিপক্ষের কথা সবসময় উড়িয়ে দিতে হয় না, কখনো কখনো আমলেও নিতে হয়। আরেক দল আছে যারা নামে বুদ্ধিজীবী হলেও মূলত শাসকগোষ্ঠীর স্তাবক। তারা তাদের মেরদণ্ড বন্ধক দিয়ে রেখেছে ক্ষমতার কাছে, তাদের বিবেক বন্ধক দিয়ে রেখেছে শাসকগোষ্ঠীর কাছে। শাসকগোষ্ঠী ভালো করলে তারা প্রশংসা করে, খারাপ করলে চুপ থাকে। ন্যায়-অন্যায় বোঝার ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু যখন কোনো অন্যায় সংগঠিত হয় তখন তারা চুপ করে থাকে। শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করতে তাদের হাত কাঁপে। তারা নিজেদের মুখে বসিয়ে নিয়েছে একটা সেন্সর মেশিন। সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার আগে তারা সেই মেশিনে কথাকে সেন্সর করে নেয়।

যদি ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। যদি সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। যদি পুরস্কার-সম্মাননা অধরা থেকে যায়। এরা সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। এদের কারণে ধ্বংস হয়ে যায় একটি দেশ, ধ্বংস হয়ে যায় একটি জাতি। বুদ্ধিজীবীদের আরেকটা শ্রেণী আছে যারা শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করে বটে, কিন্তু তাদের কথা কর্ণপাত করে না শাসকগোষ্ঠী। তাদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। কারণ শাসকদের এই ধারণা হয়ে গেছে যে দেশ চালাতে গেলে বুদ্ধিজীবীদের দরকার হয় না। কবি সাহিত্যিক শিক্ষক সাংবাদিকদের দরকার হয় না। বিবেকের প্রয়োজন হয় না, সাহিত্য সংস্কৃতি বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন হয় না। কারণ শাসকেরা অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী, তাদের মধ্যে ক্ষমতার অতিমাত্রার দম্ভ। সেই আত্মবিশ্বাস ও দম্ভের কারণে তারা মনে করে আমি যা করছি তা-ই ঠিক, আমি যা বলছি তা-ই ঠিক। আমি কোনো ভুল করতে পারি না, আমার কোনো অন্যায় হতে পারে না। আমি সম্পূর্ণরূপে ভুলের উর্ধ্বে। যে পরিস্থিতিতির মধ্য দিয়ে আমরা গেলাম, তাতে বারবার একটা কথাই মনে হয়েছে, আসলে আমাদের কোনো অভিভাবক নেই, যিনি সকল বিতর্কের উর্ধ্বে, যিনি সকলের নমস্য। যদি থাকতেন, তবে তিনি আমাদের যে কোনো সংকটে দাঁড়িয়ে যেতেন রাজপথে। দুই হাত তুলে বলতেন, কী সমস্যা হয়েছে তোমাদের বলো? আসো তোমরা, আমার কাছে আসো, আমার কাছে তোমাদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলো। 

আমিই সমাধান দিচ্ছি। তোমার আমার কথা শোনো। হায়, আমাদের কোনো অভিভাবক নেই। আমাদের কোনো দিশারী নেই। যে দশা দেখেলাম এই দেশের, তাতে একজন গৌণ লেখক হিসেবে আমার মধ্যে আশার যে ফানুস উড়ছিল, তা ভূমিস্যাৎ হয়ে গেছে। আশার যে প্রদীপ জ্বলছিল, তা নিভে গেছে। আশার যে স্বপ্ন দেখছিলাম, তা ভেঙে গেছে। কেবলই মনে হচ্ছে, কী হবে এইসব লেখালেখি করে? কী লাভ? কার জন্য করব? কাকে পড়াব? মানুষ বুঝি এভাবেই স্বপ্নহীন হয়ে যায়। বুঝি এভাবেই আশাহীন হয়ে যায়। বুঝি এভাবে একদিন সে স্বপ্নহীন আশাহীন জীবন্মৃত হয়ে যায়। কিন্তু লেখক তো জীবন্মৃত হয়ে থাকতে পারে না। সে তো কালের ভাষ্যকার। সে রক্তস্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়েও তার কাজটি করে যায়। সে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়েও তার কাজটি করে যায়। সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও সে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে আসন্ন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। স্বপ্ন দেখে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তির। কেননা স্বপ্ন দেখাই তার কাজ। কেননা স্বপ্ন দেখানোই তার সাধনা।  লেখক: কথাসাহিত্যিক। ২৭.০৭.২০২৪।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়