শিরোনাম
◈ ইরানে হামলা করলে বিপর্যয় নেমে আসবে: রাশিয়ার হুঁশিয়ারি  ◈ নির্বাচনের সম্ভব্য সময় নিয়ে বিতর্ক, সন্দেহ-সংশয়ে রাজনীতিবিদরা ◈ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন: প্রথম দিনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন দু’জন ◈ দেশব্যাপী ব্ল্যাকআউট: ক্ষমা চেয়ে ৪ দফা দাবী তুলে ধরেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা ◈ পরিবারসহ রাতের আঁধারে ভারতে যাওয়ার পথে ধরা পড়লেন তারা ◈ জয়পুরহাটের পাঁচবিবি সীমান্তে বিএসএফের কাঁটাতার, বিজিবির বাধায় পণ্ড ◈ ১৯ দিনে ডেঙ্গুতে ৭৮ জনের প্রাণহানি ◈ সৌদির টিভি অফিসে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ বলায় হামলা-আগুন ◈ স্বর্ণের দামে বিশ্ববাজারে নতুন ইতিহাস ◈ প্রায় ৯ ঘণ্টা পর আল্টিমেটাম দিয়ে শাহবাগ ছাড়লেন আউটসোর্সিং কর্মীরা

প্রকাশিত : ১৭ জুলাই, ২০২৪, ১২:৩৪ রাত
আপডেট : ০৫ অক্টোবর, ২০২৪, ০২:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শিল্পকলা একটি রাজনৈতিক তৎপরতা

আহসান হাবিব

আহসান হাবিব: [১] মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণী কথাটার মানে আমি যা বুঝি তা হলো পৃথিবীর যেকোনো মানুষ কোনো না কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক বা অধিবাসী আর রাষ্ট্র হলো রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন। রাষ্ট্রের বাইরে থাকা কি কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব? সম্ভব নয়, তবে কেউ যদি এমন কোনো স্থানে বসবাস করতে শুরু করে যেখানে আর দ্বিতীয় কোনো মানুষ নাই, একা এবং তার বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি ছাড়া আর কোনো উপাদান নাই, তাহলে ভিন্ন কথা। তবে এমন মানুষ নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নাই। আমরা আগ্রহী সমাজস্থিত মানুষ যে একটি রাষ্ট্রে বাস করে। যদি তাই হয় তাহলে তার প্রতিটি কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক। আর রাজনীতি পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয় যে চেতনা দিয়ে তার নাম শ্রেণিচেতনা। রাষ্ট্র তাই শ্রেণির রাষ্ট্র।

[২] এখন প্রশ্ন হলো শিল্পকলা কি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড? প্রশ্নটিকে অহেতুক সরল মনে হতে পারে কারণ বলাই তো হলো মানুষের প্রতিটি কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক, তাহলে আলাদা করে শিল্পকলা কেন? কারণ অনেকেই মনে করে শিল্পকলা রাজনৈতিক বিষয় নয়, এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসের কোনো যোগ নেই। তারা মনে করে শিল্পকলা মেনে চলে শিল্প নির্মাণের অন্তর্গত তাড়না যা কেবলই সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। অর্থাৎ এখানে তাদের বক্তব্যে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই তত্ত্বের দেখা পাই। অথচ যেকোনো সৌন্দর্য রূপ লাভ করে ব্যক্তির শ্রম দিয়ে। যখনই কোনো কিছু সৃষ্টিতে শ্রম যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন তা আর ব্যক্তিক থাকে না, সামাজিক হয়ে ওঠে। তবে সেই শিল্প যদি মনুষ্যসমাজে প্রদর্শিত না হয়, তবে তা নিয়ে ভাববার মাথাব্যথা কারো নেই। আমরা বলছি সেই বস্তুর কথা যা মানুষের সামনে এসেছে এবং তার একটি পণ্যমূল্য সৃষ্টি হয়েছে যার মূল উপাদান সৌন্দর্য এবং এর একটি চাহিদা আছে। কিন্তু সকলেই সব পণ্য ক্রয় করতে পারে না, ফলে এখানে সৌন্দর্য উপভোগের প্রশ্নে এসে তা ব্যক্তিক হয়ে ওঠে।

একটি শিল্পকলায় কী থাকে? থাকে শিল্পীর চেতনা। সেই চেতনা নির্মিত হয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। এর বাইরে কোনো শিল্পী যেতে পারে না। আন্না কারেনিনায় তলস্তয় দেখাচ্ছেন অভিজাত ভূস্বামীদের হটিয়ে একটা শ্রেণি গজিয়ে উঠছে যে সকল কিছুর দখল নিতে চাইছে, কিন্তু এই সত্যকে তিনি মেনে নিতে পারছেন না। অর্থাৎ তিনি অভিজাত ভূস্বামী শ্রেণির পক্ষেই তার অবস্থান গ্রহণ করছেন, উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণিকে নয়। লিখছেন রাজনৈতিক সামাজিক বিকাশের সত্য, কিন্তু তিনি তার পক্ষ নিচ্ছেন না, ফলে তিনি রক্ষণশীল থেকে যাচ্ছেন। এটা দোষের কিছু নয়, এটা তার সীমাবদ্ধতা, কিন্তু তিনি সামাজিক সত্যটিকে দেখাতে কোনো পক্ষপাতিত্ব করছেন না। এজন্যই তিনি মহান সাহিত্যিক।

[৩] মানুষ যেকোনো বিষয় নিয়ে শিল্প নির্মাণ করতে পারেন। দর্শনগত দিক দিয়ে মানুষ প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত। একটা ভাববাদী আর একটা বস্তুবাদী। ভাববাদী চিন্তার শিল্পী বস্তুর সত্য নিয়ে শিল্প নির্মাণ করতে পারেন এবং শিল্পের ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। বস্তুবাদী চিন্তার মানুষও শিল্প নির্মাণ করতে পারেন, যা ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। পৃথিবীর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলি ভাববাদী চেতনাদ্বারা চালিত। ধর্ম কিংবা সম্প্রদায় নিয়ে যে কেউ শিল্প রচনা করতে পারে। কিন্তু কখন তা পরিতাজ্য? যখন তার ধর্ম বা সম্প্রদায়কে সেরা বলে অন্যের উপর চাপিয়ে দেবে, মানতে বাধ্য করবে। তখন শিল্পকলা আর মানুষের থাকবে না, হয়ে উঠবে খণ্ডিত সম্প্রদায়ের বা নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের। এসব পরিতাজ্য তার প্রধান কারণ ধর্ম বা সাম্প্রদায়িক চেতনা সমাজিবিকাশের পরিপন্থী। যা বিকাশবিরুদ্ধ, তা পরিতাজ্য।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে এসব রচনা একদল মানুষ মাথায় নিয়ে নাচবে না। নাচবে তারাই যারা ধর্ম বা সাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে শিল্পকলা রাজনীতি বহির্ভূত কোন বিষয় নয় যেখানে কম করে হলেও দুটি দল থাকবে।

[৪] ধর্ম বা সাম্প্রদায়িক চেতনা যে জাতীয় ইতিহাসের অংশ এবং তাদের ভূমিকা দিয়েই তাদের চিহ্নিত করা হয়। আমাদের দেশে অনেক কবি, সাহিত্যিক আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন। এই বিরোধিতা এসেছে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় চেতনা থেকে। তাদের সমস্ত সৃষ্টি স্বাধীনতাবিরোধী, ফলে জাতীয় ইতিহাসের তাদের স্থান ভাগাড়ে তা সেই নির্মিতি যেমনই হোক। কারণ ধর্ম বা সাম্প্রদায়িক চেতনা দিয়েও অনেক ভালো শিল্প সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু তা শিল্পের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতা দোষে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শিল্পকলা যে একটি দর্শনগত রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ তার প্রমাণ ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে। আমাদের দেশেও আছে।

অনেক বিখ্যাত কবি বা সাহিত্যিক যখন তাদের চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, তখন তাদের রচিত শিল্প মানুষের জয়গান গেয়েছে, সমাজিবিকাশের পক্ষে শৈল্পিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, কিন্তু যখনই তার বিচ্যুতি ঘটেছে, তখনই তার পদস্খলন ঘটে গেছে। তার রচনা সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। সুতরাং একজন শিল্পস্রষ্টা যে আসলে দার্শনিক চেতনা দ্বারাই চালিত যা শিল্পরচনায় বিধৃত হয়, তা প্রমাণিত সত্য। সাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে যদি যুক্ত হয়ে পড়ে জাতীয় ইতিহাসের বিপক্ষে দাঁড়ানোÑ যেমন আমাদের এখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়া, তাহলে তার রচিত শিল্প নিজেরই বিরোধী হয়ে ওঠে এবং শিল্পকলার ইতিহাসে তার রচনা কালিমালিপ্ত হয়ে পড়ে। সেই শিল্প মানুষের কোন কাজে আসে না কারণ মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণি, শিল্পী শুধু নয়, একজন ফেরিওয়ালাকেও দেখা হয় রাজনীতির আলোকে। [৫] আমার কথা এটুকুই যে শিল্পকলা একটি রাজনৈতিক তৎপরতা এবং সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসই তাতে বিধৃত থাকে, এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। এখন কে কোন রাজনৈতিক চেতনা ধারণ করবে, শিল্পকলা গ্রহণ বর্জন সেই নিরিখেই বিবেচ্য হয়। একজন অসাম্প্রদায়িক সমাজিবিকাশের পক্ষে বস্তুবাদী চিন্তার মানুষ হিসেবে জাতীয় প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতাবিরোধী এবং দর্শনগত ভাববাদী সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন যেকোনো লেখক, সাহিত্যিক শিল্পীর সৃষ্টিকে পরিত্যাগ করি। ইতিহাসে তাদের স্থান একটাইÑ ভাগাড়। লেখক: কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়