মানবর্দ্ধন পাল: বাসের কন্ডাকটরের মুখে উচ্চারিত ‘ওপ’ নিয়ে লিখেছিলাম। পাঠকদের মন্তব্য থেকে বুঝতে পারলাম, শব্দটি শুধু এদেশেই নয়, ভারতের দিল্লিতেও উচ্চারিত হয়। বন্ধু Sanjib Kumar Devnath এই তথ্যটি জানিয়েছেন। দুজন বিজ্ঞ পাঠক আমার বক্তব্যে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা। ব্যাকরণ, ভাষা ও শব্দের চালচিত্র নিয়ে লেখা-যে এতো পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তা ভাবতে পারিনি। যাক, আজকের প্রসঙ্গে আসি। যারা নিয়মিত লোকাল বাসোর যাত্রী তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, গাড়ি থামাতে গেলে তারা যেমন ‘ওপ্’ বলে তেমনই চলার সংকেত দেয় ‘হেই’ বলে। এই শব্দটি ওরা একবারই উচ্চকণ্ঠে টেনে বলে হে ই ই ই ই। এরকম টেনে উচ্চারণের মধ্যে গতির একটি আবহ আছে। চলার সংকেত বা ‘চলুন’ অর্থ বোঝাতে এই ‘হেই’ কোত্থেকে কীভাবে এলো কন্ডাকটরের মুখে?
শ্রমজীবী মানুষের মুখের ভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যা তাদের নিজস্ব। এই শব্দগুলো তারা সম্মিলিতভাবে বল-প্রয়োগের সময় ব্যবহার করে। কোনো ভারি বস্তু উপরে ওঠাতে বা ঠেলে অন্য জায়গায় নিতে তারা বলে, মারো ঠেলাÑ হেইয়ো, সাবাস জোয়ানÑ হেইয়ো, আরো জোরে, হেইয়ো। শ্লোগানের মতো তা উচ্চারণ করা হয়। প্রথম অংশটি একজন বলে, যিনি ওস্তাদ বা নেতা। পরের অংশ বলে সহকর্মীরা। এটি ছন্দেছন্দে শরীরে আরো বেশি শক্তিসঞ্চারের প্রক্রিয়া। যাদের রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পটির কথা মনে আছে তারা জানেন, গল্পের শুরুতে ফটিক তার বন্ধুদের নিয়ে একটি গাছের গুড়ি ‘মারো ঠেলা হেইয়ো’ বলে নদীতে ফেলার চেষ্টা করছিল। আমি নিজেও দেখেছি, পাঁচ মন ওজনের ড্রাম বা ওজনদার বস্তু স্থানান্তর করতে কুলিরা শক্তিসঞ্চারী এই শ্লোগান ব্যবহার করে। আমার মনে হয়, সেই ‘হেইয়ো’ শব্দটির প্রথমাংশ ‘হেই’ মোটরের গতিশক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে চলে এসেছে কন্ডাকটরের মুখে। এই সাংকেতিক ভাষা ইঞ্জিনের চলচ্ছক্তি দানের রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কন্ডাকটরের মুখে। তাছাড়া ‘হেই’ শব্দটি আমরা ইতর জাতীয় প্রাণিকে তাড়াতেও প্রয়োগ করি। গরু-ছাগলকে তাড়াতে আমরা বলি ‘হেই’। আবার পাখিকে তাড়াতে বলি, ‘হুস্’। তাই আমার যৌক্তিক ধারণা, লোকজীবনে শ্রমজীবী মানুষেরা শক্তিসঞ্চারের জন্য যে ‘হেইয়ো’ শব্দ প্রয়োগ করে তা-ই ইঞ্জিনের চলচ্ছক্তি দেওয়ার প্রতীক হিসেবে বাস-কন্ডাকটারদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
আপনার মতামত লিখুন :