মহিউদ্দিন খালেদ: আমি কখনো সরকারি চাকরি করিনি। আমার জন্য একমাত্র সুযোগ ছিল বিসিএস। বিসিএস পরীক্ষা দিইনি। অবশ্য দিলেই যে টিকে যেতাম সেটা আমার মনে হয় না। অনেকে মনে করে, যারা বুয়েটে চান্স পায় তাদের জন্য বিসিএসে চান্স পাওয়া কোনো ঘটনা না। এরকম যারা মনে করে তাদের সাথে আমি একমত নই। কারণ বুয়েটে চান্স পাবার জন্য শুধু একটা লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। সেটাতে টিকলে ভর্তির আগে প্যান্ট খুলে যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কিনা দেখে। কেন দেখে সেটা জানি না। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কাউকে যন্ত্রদর্শনোত্তর বাদ দিছে, এরকম কথা কখনো শুনি নাই। মোদ্দা কথা, একটিমাত্র লিখিত পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞান, গণিত এবং রসায়ণ বিষয়ে করা প্রশ্নগুলোর উত্তর ঠিকঠাকমত দিতে পারলেই বুয়েটে চান্স পাওয়া যায়। এখন সম্ভবত ইংরেজিও প্রশ্নপত্রে থাকে। আমাদের সময় ছিল না। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি পাবার আগে অনেকগুলো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। প্রিলিমিনারি, রিটেন, ভাইভা অনেককিছু। এতগুলো পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে আসতে পারতাম বলে আমার মনে হয় না। কোনো না কোনোটাতে ঠিকই ধরা খেতাম। তারপর মেসে ফিরে একটা আবুলবিড়ি ধরিয়ে একটা দার্শনিক কবিতা ( জীবনের জন্য বিসিএস টিসিএস এসব কত তুচ্ছ এই মর্মে) লিখে ঘুমিয়ে পড়তাম। পরদিন সকালে উঠে টিউশনিতে যেতাম।
বিসিএস দিয়ে যারা সরকারি চাকরি পায় তারা যোগ্য বলেই পায়। তাদের বাংলা-ইংরেজি-অংকজ্ঞান, দেশ বিদেশ সম্পর্কে সাধারণজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তোলা চলে না। বিসিএস ক্যাডার যাদের আমি কাছ থেকে দেখেছি তাদের কাউকে আমার কখনোই অযোগ্য মনে হয়নি। আবার এমনো মনে হয়নি তারা একেকজন অমর্ত্য সেন দি গ্রেট। যদি ঈর্ষার চোখে দেখতাম তাহলে অতি তুচ্ছ কারণেই তাদের অযোগ্য মনে হত। যদি ভক্তির চোখে দেখতাম তাহলে অতি তুচ্ছ কারণেই মনে হতো তারা অমর্ত্য সেন দি গ্রেট। আমি সাদামাটা চোখে দেখেছি। এতে করে মনে হয়েছে শিক্ষা, যোগাযোগদক্ষতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, স্মৃতিশক্তি, নেতৃত্বগুন সব মিলিয়ে এদের যোগ্যতার একটা লেভেল আছে যেটা তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য যথাযথ।
বর্তমানে প্রশ্নফাঁস, কোটাপ্রথা ইত্যাদির ফাঁপরে পড়ে যদি অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, অযোগ্য লোকজন বিসিএস ক্যাডার হয়ে যায় তাহলে কী হবে? আমার মনে হয় অবস্থা ভয়াবহ হবে। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্ক হাইওয়েতে এরা প্রচুর রোডব্লক তৈরি করবে। হাইওয়েতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি তিরিশচল্লিশ ভাগ ছেড়ে দিলে যা হয় তাই হবে আর কি। যারা তুলনামূলক দুর্বল তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা আর যে যে কাজের যোগ্য নয় তাকে সেই কাজ করতে দেয়া এক জিনিস নয়। ধরেন, আপনি নিজের গাড়িতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন। মাত্র স্টিয়ারিং ধরতে শিখছেনÑ এরকম একটা ড্রাইভারকে কি আপনি আপনার গাড়ি চালাতে দেবেন? বেচারার চাকরি নাই এই কারণে? আপনার যদি সামর্থ্য, মানবিকতা এবং কাণ্ডজ্ঞান থাকে তাহলে তাকে আপনি অন্যভাবে হেল্প করবেন। ড্রাইভারের চাকরি দিয়ে না। পরে যে অতি সাধারণ কথাগুলো বললাম এগুলো কি নীতিনির্ধারকরা বোঝে না? অবশ্যই বোঝে। তারপরেও এই ভয়াবহ অন্ধকারগুলোতে আমরা নিমজ্জিত হই কেন? সম্ভবত ক্ষমতা এবং টাকার লোভ। আমরা সম্ভবত মানুষ হিসেবে অতি নিম্নশ্রেণির। আমাদের মাথায় কোনো কবিতা নাই, গান নাই, কোনো নান্দনিক সৌন্দর্য নাই, স্বার্থহীন মমত্ববোধ নাই, কিছুই নাই। দেশ নিয়ে জাতি নিয়ে কোনো স্বপ্নও নাই।
নিম্নমানসিকতার কারণে, চারিত্রিক সততা অর্জনে ধর্মও আমাদের কোনো কাজে আসেনি। ধর্ম নিয়ে কেউ নেমে গেছে সরাসরি ব্যবসায়, আর কেউ ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নানাবিধ কুকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মকে অবলম্বন করার ধার্মিক বলতে গেলে নাই। কিন্তু ধর্মকে পুঁজি করা ধার্মিকের অভাব নাই। যে অবলম্বন করে তার জীবনযাপন বাহুল্যবর্জিত হয়, তার অন্তরে মমতা জন্মায়, সততা জন্মায়, কারণ সে পার্থিব জীবনকে মনে করে অনন্তসত্তার সাথে মিশে যাবার আগের একটা ক্ষণকাল মাত্র। আর যে পুঁজি করে তার জীবনযাপন বাহুল্যমন্ডিত হয়, তার অন্তরে হিংসা জন্মায়, শঠতা জন্মায়। কারণ সে ইহকাল এবং পরকাল, দুই কালেই খালি খাওয়ার, ভোগ করার তালে থাকে। শুয়োরের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ কিছু টাকা কামানো, কিছু দানবীয় ক্ষমতা, ছেলেমেয়েদের চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো প্রদর্শনযোগ্য প্রাণী বানানো, এর চেয়ে অধিক উচ্চতায় আমাদের মনন কখনো আরোহণ করতে পারেনি। এজন্য আমরা কখনো সৎ হইনি। সংকীর্ণ সম্পদলোভী-ক্ষমতালোভী-তকমালোভী মানসিকতা নিয়ে আর যাই হওয়া যাক না কেন, সৎ মানুষ হওয়া যায় না। মননের দিক দিয়ে আরেকটু উচ্চ হলে আমার ধারণা আমরা জাতি হিসেবে আরো সৎ হতাম। এই একটা ফ্যাক্টর পরিবর্তন হয়ে গেলে আমাদের ঠেকানো যেত না। সাভার স্মৃতিসৌধের মতো প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা দুমড়ে মুচড়ে আমরা ঠিকই আকাশের দিকে উঠে যেতাম। ১৩ জুলাই, ২০২৪। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :