শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৪ জুলাই, ২০২৪, ০২:০৭ রাত
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৯:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

পিএসসির প্রশ্নফাঁস : আমাদের স্বপ্ন-সংগ্রামের নিষ্ঠুর পরিহাস

ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল

ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল: সৈয়দ আবেদ আলীর পারিবারিক নাম ছিলো আবেদ আলী মীর। কীভাবে, কবে তিনি সৈয়দ হলেন তা জানা যায়নি। ১৯৯৭ সালে ঢাকায় এসে রাজা বাজারে ব্যাচেলর মেসে ওঠেন। সে সময় মেসের এক ভাইয়ের মাধ্যমে তার পিএসসিতে গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি হয়। সেই ভাই ছিলেন সচিবালয়ের ড্রাইভার। ১৯৯৭/৯৮ সালে পিএসসির চাকরিতে ঢোকার পর থেকে আবেদ আলীর ভাগ্য বদলাতে শুরু করে। প্রফেসর ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগম পিএসসির চেয়ারম্যান হন ২০০২ সালে। সে সময় থেকেই মূলত সৈয়দ আবেদ আলী প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িয়ে পড়েন। এরপর দীর্ঘসময় ধরে তিনি একটি চক্রের সঙ্গে প্রশ্নফাঁস করে আসছিলেন। তবে ওই সময়ে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিলেন।-(তথ্য সূত্র: কালবেলা)। 

প্রফেসর তাহমিদা বেগম পিএসসির চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর নেন ২০০৭ সালে। অনেকেরই জানা থাকবে যে পিএসসির প্রশ্নফাঁসের ধারাবহিক মহোৎসব চলেছিলো মূলত ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত। প্রফেসর তাহমিদা দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৪ তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেই পরীক্ষা প্রশ্নফাঁসের কবলে পড়ে। ইতিহাসের এক সর্ববৃহৎ কেলেঙ্কারি সূত্রপাত হয়। দৈনিক যুগান্তরসহ কিছু পত্রিকা বলছে, পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হন পিএসসির চেয়ারম্যান ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগমের পুত্র তাহসান খান। যিনি সংগীত শিল্পী ও অভিনেতা হিসেবে অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয়। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা বাতিল হলে বাদ পড়েন। তবে ফ্যাক্ট চেক করে দেখা যায় তথ্যটি সঠিক নয়। ২০১৩ সালে আসেন ড. ইকরাম আহমেদ। মূলত ইকরাম আহমেদ আসার পরই আবেদ আলী কিছুটা চাপে পড়েন। তারপরও ২০১৪ পর্যন্ত ড্রাইভার আবেদ আলী মোটামুটি নিরাপদেই ছিলেন। ২০১৪ সালে নন-ক্যাডারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পিএসসির চাকরি থেকে আবেদ আলীকে বরখাস্ত করা হয়েছিলো।-(দৈনিক যুগান্তর) 

পিএসসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নন-ক্যাডারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদের লিখিত পরীক্ষা ২০১৪ সালে ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই পরীক্ষায় এক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে হলের বাইর থেকে অবৈধভাবে সরবরাহকৃত সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরসহ ৪টি লিখিত উত্তরপত্র হাতেনাতে ধরা হয়। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ আইনের ধারায় মামলা করা হয়। ওই মামলার তদন্তে সৈয়দ আবেদ আলীর সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য-প্রমাণ মেলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।-(দৈনিক যুগান্তর)

আবেদ আলী সহ প্রশ্নফাঁস চক্রের প্রায় অর্ধশত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয় সেই সময়। তারই প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে আবেদ আলী সহ অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। সম্প্রতি আবেদকাণ্ড ভাইরাল হবার পর অনেকেই ড. সাদিককে সন্দেহ করেছেন বা আশঙ্কা করেছেন। ড. সাদিক পিএসসির চেয়ারম্যান হয়েছেন ২০১৬ সালে।  ততোদিনে আবেদ আলী পিএসসি থেকে চাকরিচ্যুত। আবেদ আলী চাকরিচ্যুত হবার পরও এই সিন্ডিকেটের সাথে কাজ করতে থাকেন। প্রশ্নফাঁসের ক্লায়েন্ট খোঁজার কাজটি তিনি করতেন। সাথে সহযোগী হিসেবে যুক্ত করে নেন তার পুত্রকে। আবেদ আলী এ সময় পলিটিক্সে মন দেন। প্রচুর আওয়ামী লীগ করেন।  পুত্র ছাত্রলীগের কেন্দ্রের কোনো এক কমিটিতে ঢোকে। রাজনীতির পথে পথে টাকাপয়সা খরচা করে পদ-পদবি বাগায় বাপ ও ছেলে। অবশ্য আবেদ আলী স্বয়ং আল্লাহর রাস্তাতেও প্রচুর টাকা খরচ করেছেন বলে নিজ মুখে জানিয়েছেন। 

আবেদ আলীর সাথে আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতাবান এরকম বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তারও বেশ সখ্য রয়েছে বলে অনুমান করা যায়।  ফেসবুকে বিভিন্ন ছবিতে সেইসব কর্মকর্তাদের সাথে আবেদ আলীর দেহভঙ্গি বেশ জড়তাহীন এবং ঘনিষ্ঠ। বড়কর্তাদের তিনি ভাই বলে সম্বোধন করেছেন। কিছু ব্যক্তিগত কথা বলি। আমি নিজেও প্রিলি (২৭ তম বিসিএস)পাস করি প্রফেসর জিনাতুননেসা তাহমিদা দায়িত্বে থাকাকালীন প্রশ্নফাঁসের মহোৎসবের কালে। রিটেন, ভাইভা পাস করার পর ঠিক নিয়োগের আগে আগে আমাদের সেই নিয়োগ বাতিল হয়। আমি তখন সদ্য বিবাহিত। নিয়োগ বাতিল হবার আগে  সদ্য ক্যাডার জামাতাকে স্যুটের কাপড় গিফট করেছিলেন আমার শ্বশুর। স্যুট বানাতে দেওয়ার আগেই নিয়োগ বাতিল! 

১/১১ সরকার সেই পরীক্ষা আবার নেয়। আবার পাস করি। নিয়োগও পাই। কিন্তু এর মধ্যে কেটে যায় আড়াই বছর। আমার জীবনের অনেক সিদ্ধান্ত, হিসাব-নিকাশ বদলে যায় এই সময়ে। কঠিন সংগ্রামমুখর সময় কাটে। অনেককিছু কম্প্রোমাইজ করতে হয়। যার জের টানছি আজও। বারবার বিসিএস পরীক্ষা বাতিল হওয়ার সুবাদে আমি ও আমরা যখন প্রচণ্ড জীবনযুদ্ধে লিপ্ত সেইসময়ে ড. জিনাতুন্নেসা তাহমিদা বেগমের পুত্র তাহসান খান একজন তুমুল জনপ্রিয় গায়ক। পিয়ানো বাজিয়ে গান করেন। ব্যান্ড দলেও  ছিলেন। আমারও গায়ক হওয়ার স্বপ্ন ছিলো। তাহসানের গ্র্যান্ড পিয়ানো বাজানো একটা ছবি দেখে আমার মনে হয়েছিলো যদি কোনো দিন আমার একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো থাকত, আর সেটা বাজিয়ে গান করতে পারতাম! যদি আমিও একটা এলবাম করতে পারতাম। কিন্তু সেসময় আমার স্বপ্ন চাপা পড়ে যায় জীবনযুদ্ধের ডামাডোলে। গ্র্যান্ড পিয়ানো আর এলবামের স্বপ্ন দেখে আমি আমার স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা অথবা নিজের অপেক্ষাকৃত সহজ, নিরাপদ, সম্ভাবনাময় পেশাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারিনি। এখন জীবনের যে পর্যায়ে আছি সেখানে জীবনযুদ্ধ আর যুদ্ধ নেই। এখন সম্মান বজায় রেখে জীবনকে চালিয়ে নেওয়াটাই যুদ্ধ। কিছু কিছু ছোট ছোট স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। ছেলেটা একদিন নিজের একটা পরিচয় তৈরি করবে। আমরা একটা বড় বাসা কিনবো। আমার সেই বাসার ড্রইং রুমে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো থাকবে। আমি টিচার রেখে পিয়ানো বাজানো শিখব। লেখক: চিকিৎসক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়