শিরোনাম

প্রকাশিত : ১২ জুলাই, ২০২৪, ০৩:২৫ রাত
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৬:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ঝগড়া করে মানসিক শান্তি নষ্ট করবেন না

জিয়া আরেফিন আজাদ

জিয়া আরেফিন আজাদ: মানুষ কেন ঝগড়া করে? ইন্টারনেটে সাইকোলজি/সাইকিয়াট্রির বেশকিছু পেজ ঘেঁটে এই বিষয়ে অনেক তথ্য জানলাম। কষ্ট করে এসব পড়ার দরকার ছিল না। কমনসেন্স থেকেই সিদ্ধান্তে আসা যেত। ঝগড়ার সংজ্ঞাটা প্রথমে পরিষ্কার করা দরকার। বাংলা একাডেমির ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে’ ‘ঝগড়া’ ভুক্তি-১ এ লেখা আছে বিশেষ্য: কলহ ২ কলহমূলক ৩ তর্কাতর্কি, বাদানুবাদ, বচসা ৪ বিবাদ। এখানে ভুক্তি ৪ বিবাদ অর্থটা কিছুটা দূরবর্তী। গণ্ডগোলও অনেকটা ভিন্ন। আর যুদ্ধ তো সম্পূর্ণই আলাদা। ঝগড়া মূলত ওরাল। মানুষ যুদ্ধ করে কিছু অর্জন বা রক্ষা করার জন্য। আর ঝগড়া করে কিছু খোয়ানোর জন্য। যুদ্ধ করে সবলেরা। ঝগড়া করে দুর্বল, রুগ্ন ও বিকলাঙ্গেরা। বলা বাহুল্য, আমরা গোটা জাতিই দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্গত। দুর্বল, রুগ্ন, হীনমন্য মানুষ খুব সহজে নিজেকে আক্রান্তবোধ করে। নিজের উপর তার কোনো আস্থা থাকে না। সেই কারণে অন্যকেও আস্থায় নিতে পারে না। যুক্তি, ধৈর্য্য ও কলাকৌশল দিয়ে নিজ স্বার্থ বা সম্মান রক্ষার উপায় তার অজানা। এই কারণেই আমাদের দেশের মানুষ কথায় কথায় ঝগড়া করে। কোনো ইস্যুতেই তারা মীমাংসায় পৌঁছাতে পারে না। 

আমি এক সময় প্রচুর টকশো দেখতাম। আমাদের সেলিব্রিটি বক্তারা কীভাবে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে নানা প্রকার কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে একে-অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করতেন, সেটা দেখে আমি খুবই অশান্তি অনুভব করতাম। প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে তারা চিৎকার করতেন। আমি মনে করতাম, বিবদমান ইস্যুগুলো তাদের জীবনমরণ কোনো বিষয়। পরবর্তী সময়ে আমার ধারণা ভাঙলো। আমি দেখলাম, ভিন্ন কোনো সময়ে, ভিন্ন পরিবেশে এই লোকগুলোই ভিন্নভাবে কথা বলছে। যে লোকটিকে চরম অসহিষ্ণু দেখেছি, ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাকেই আবার ধৈর্য্যরে প্রতিমূর্তি দেখতে পাই। দেখে মনে হবে তিনি সাক্ষাৎ গৌতম বুদ্ধ কিংবা শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তারপর আরও দেখতে থাকলাম। ধীরে ধীরে আমার চোখ খুললো। সাইকোলজি বইয়ের ভ্যাজর ভ্যাজর পড়ার আগেই আমার ব্যবহারিক ক্লাস হয়ে গেছে।

আমার যেটা ব্যারাম, কোনো সমস্যা দেখলে তার সমাধান খুঁজতে লেগে যাওয়া। আমি সমাধান খুঁজতে থাকি। ছোটবেলায় শুনেছিলাম, একজন সহিলে কোন্দল হয় দূর। কোনো একজন সহ্য করবে। যে সবল, তাকেই সহ্য করতে হবে। কিন্তু এ দেশে তো সবল মানুষ নেই। বাংলাদেশ একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে অপুষ্টি, ব্যাধি, বিকলাঙ্গতা, দুর্নীতি ও মিথ্যাচারের বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। কেউ কম, কেউ বেশি নয়। সকলেই সমান রুগ্ন। কে কাকে সহ্য করবে। কেউ আমাকে সিনিক মনে করতে পারেন। কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে শক্তির নিত্যতা সূত্রর মতোই ধ্রুব মনে হয়। সবকিছুরই একটা কার্যকারণ থাকে। আমাদের দেশে এতো রুগ্ন মানুষ একত্রিত হলো কী করে? বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু একটা দেশ। মিঠা পানির প্রবাহ এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর কারণে এখানে সকল প্রকার প্রাণের জ্যামিতিক বৃদ্ধি হতে থাকে। ট্রপিকাল আবহাওয়ায় শতাব্দীর পর শতাব্দী বারো-তেরো বছরের শিশুরা ডজন ডজন সন্তানের মা হয়েছে। নিজেদের শরীরের বৃদ্ধি হওয়ার আগে নতুন নতুন জীবনের জন্ম দিয়েছে। জন্মের সময় প্রতিটি শিশু কাক্সিক্ষত মাত্রার চেয়ে অনেক কম আয়রন, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য ধাতু নিয়ে বেড়ে ওঠে। যার ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী এখানকার জনগোষ্ঠি হতে থাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাকার। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির এই দেশে সকলের খাবারও যোগান হতো না। এর সাথে ছিল সামন্ত কাঠামোর ঔপনিবেশিক শাসন। যার ফলে খাজনা যোগান দিতে গিয়ে আধাপেটা থাকতে হত। দেশ স্বাধীন হলেও ঔপনিবেশিক কাঠামো এবং সামন্ত মনস্তত্ব রয়ে গেছে। সামন্ত মনস্তত্ব একজন মানুষকে অপর মানুষের সমান ভাবতে শেখায় না। হয় তুমি তার অধীন অথবা সে তোমার অধীন। আর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো যে কাজ করে তা হল পীড়নের মাধ্যমে এই সমাজ এবং এই মনস্তত্ব টিকিয়ে রাখা। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র নানা ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে ক্ষমতাবান ও দুর্বল সকলের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা জিইয়ে রাখে। এখানে ক্ষমতাবানরা বেশি নিরাপত্তাহীন বোধ করে। তাই তারা পীড়নকে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় বলে মনে করে।

এরকম একটি অবস্থায় মুক্তির উপায় কী? সত্যি বলতে গেলে মুক্তির আসলে কোনো পথ নেই। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ সমস্যার প্রকৃতি ও গভীরতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না। আর রুগ্ন মস্তিষ্ক কোনো বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। কেতাবি কথায় বলতে গেলে জনসচেতনতা, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়কেই সমাধান বলতে হয়। এই দিক দিয়েও আমাদের সামনে ভীষণ অন্ধকার। কারণ জণসচেতনতা, বিপ্লবী চেতনা, গণআন্দোলন বলে যে সকল ঘটনাকে আমরা জেনে এসেছি তার অধিকাংশই জাল (fraud) বা মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ (flawed)। ১৯৪৭ এর কথিত স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার অধীন পরিচালিত একটি প্রতিক্রিয়াশীল মুভমেন্ট। সংগঠন বিস্তার ও ইতিবাচক গণসচেতনতা সৃষ্টির পরিবর্তে ঘৃণা, ষড়যন্ত্র, দাঙ্গা ও নানা প্রকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্ছিষ্টলাভকে বিপ্লব বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা জোর করে স্বাধীন করে দিয়ে গেছে। ক্ষুদ্র মানুষের যা করে, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের বিরূদ্ধে লড়াই না করে দালালি করেছি। আর নিজ দেশবাসির মধ্যে দাঙ্গা করে নিজেদের বীর ভেবেছি। ১৯৭১ আমাদের জীবনের একমাত্র গৌরবের অধ্যায়। কিন্তু সেখানেও খুব কম সংখ্যক মানুষ যুদ্ধ করেছে। অধিকাংশ লোকই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল, কোন সাইডে থাকা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোন্দল ছিল। তার পরেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অধীন আমরা ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছিলাম। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে ভারতীয় সোনবাহিনী জড়িয়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমতায়ন সীমিত হয়ে পড়ে।  এর ফল হলো, মুক্তিযুদ্ধের অল্পদিন পরেই উচ্ছিষ্টভোগী অংশটি প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে নেয়। এর পরে বড় একটি ইভেন্ট হলো ১৯৯০ এর কথিত গণঅভ্যুত্থান। জাতীয় পরিচয় ও আদর্শের জায়গাটা নিস্পত্তি না করে, গণতান্ত্রিক সংগঠন না গড়ে, উত্তরাধিকারের বিষয় অমীমাংসিত রেখে একটি রুগ্ন এবং গোঁজামিলের ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক উত্তরণ বলে আমরা প্রচার করতে থাকি। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। এসব কথা বলার অর্থ হরল্ এই সব নকল বিপ্লব কিছু ছদ্মবিপ্লবী তৈরি করেছে। আপাদমস্তক ফ্রড এসব চরিত্রকে আমরা নায়ক হিসেবে মানি। এরা ভীরু, আপোসকামী এবং ষড়যন্ত্রপ্রিয়। এরা যুদ্ধ পারে না। প্রতারণা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতায় এদের আস্থা। জনসাধারণের মধ্যে বিপ্লবী ভাবমুর্তি তৈরি করতে এরা সার্বক্ষণিক ঝগড়ুটে মুডে থাকে। এদের দেখে দেখে আমাদের সাধারণ মানুষও ঝগড়া করে। ফলে পুরো সমাজে একটা অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

এখান থেকে বাঁচার উপায় হলো ঝগড়ার পরিবর্তে আমাদের যুদ্ধ করা শিখতে হবে। বল প্রয়োগ করতে হবে। অহিংস পথে সমাধান আসবে না। শুধু দাঁতখিঁচানি নয়, প্রতিপক্ষকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার মতো আক্রোশ থাকতে হবে। স্বয়ং নিউটন বলেছেন, বাইরে থেকে বল প্রযুক্ত না হলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল সমবেগে সরলরেখায় গতিশীল থাকবে। হিংসা প্রচার করছি বলে কেউ ভুল বুঝবেন না। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি মনের মধ্যে অক্ষম ক্রোধ পুষে রাখার মানে হয় না। সহিংস হলেই একটা সমাধান চলে আসবে। আপনার প্রতিপক্ষ হয় বশ মানবে না হয় পাল্টা সহিংস হবে। শক্তি সাম্য আসলে প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হবে, সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। তাই আমার সুপারিশ হলো, ঝগড়া করে মানসিক শান্তি নষ্ট করবেন না, অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণে নানাপ্রকার শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এর বদলে আরেকটু অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করুন, সহিংস হোন। কীটের জীবনযাপন না করে, বীরের মতো বাঁচুন, অন্যকে বাঁচতে দিন। 
৫ জুলাই ২০২৪।  https://www.facebook.com/ziaarefin.azad

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়