শিরোনাম
◈ অর্থ আত্মসাৎ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে যুক্তরাজ্যে টিউলিপ সিদ্দিককে জিজ্ঞাসাবাদ ◈ সেভিয়াকে হারিয়ে দুই নম্বরে উঠে এলো রিয়াল মাদ্রিদ ◈ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেয়ার কতটা সুযোগ রয়েছে? ◈ অস্ট্রেলিয়ান ট্রাভিস হেড ভারতের মাথা ব্যথার কারণ  ◈ দিল্লিতে অবৈধ ১৭৫ বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করলো পুলিশ, শহরজুড়ে তল্লাশি ◈ ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ জয়কে অপ্রত্যাশিত বলছেন আলাউদ্দিন বাবু ◈ দীর্ঘ বছর ক্রিকেট খেলার পর আমাদের একটা স্টেজে আসা উচিত: কোচ সালাহউদ্দিন ◈ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা (ভিডিও) ◈ বিশেষ বিধান জারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ◈ ২৯ ডিসেম্বর লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া

প্রকাশিত : ১২ জুলাই, ২০২৪, ০১:২৩ রাত
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০১:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রেম, বিয়ে ও জীবন

আহসান হাবিব

আহসান হাবিব: [১] প্রেম কখনো হিসেব করে করা যায় না। প্রেম আসে, এবং কোন আভাস না দিয়েই। প্রেম হচ্ছে সেটাই যা আসে চকিতে এবং হয়ে যায় এক পলকে। চিন্তা ভাবনা দেখে শুনে লাভ ক্ষতির হিসেব করে কখনো প্রেম হয় না। হিসেব টিসেব হচ্ছে ব্যবসার বিষয়, প্রেম ব্যবসা নয়, প্রেম মূলত শিল্প যার পেছনে কলকাঠি নাড়ে হরমোন। হরমোন আপনার ইচ্ছাধীন নয়, সে কাজ করে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, তবে তার কাজের একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। বহিঃস্থ প্রতিবর্তে হরমোন সাড়া দেয় এবং সে তখন চালকের আসনে বসে ছড়ি ঘুরায়। যদি কাউকে দেখে লিবিডো জাগে, তাহলে সেক্স হরমোন নিঃসৃত হবে এবং সেক্সের জন্য ঠোকর মারতে থাকবে। যদি তা উপযুক্ত সংগী না পায়, তার নিষ্ক্রমণ যে কোন পথে হবে, মাস্টারবেশন একটি সহজ সুড়ঙ্গ। অবদমিত হলে মনের উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। প্রেমে পড়া একটি বহিঃস্থ প্রতিবর্ত, পড়ার মুহূর্ত থেকেই হরমোনের খেলা শুরু হয় এবং প্রেমে পড়া মানবমানবী তার দাস হয়ে পড়ে। তখন যে হরমোনটি নিঃসৃত হয়, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লিবিডোকে চাঙা করে তোলা। মানুষ যেহেতু সংস্কৃতিবান এবং যারা প্রেমে পড়ে তারা শুধু সংস্কৃতিবান নয়,স্মার্টও। এই দুইয়ে মিলে লিবিডোকে নিয়ন্ত্রণ করে সংস্কৃতিবান প্রেমিক হয়ে ওঠে। তবে এই সময় মানুষ যা করে তা হরমোনের সাড়ায় করে এবং তার ক্রীড়নক হয়ে ওঠে। তারা তখন ভিন্ন অবস্থাপ্রাপ্ত হয় যা সাধারণ যুক্তির বাইরে। একজন অপ্রেমিক এবং প্রেমিকের মধ্যে পার্থক্য বিপুল।

[২] প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে নারীপুরুষ কোন ভেদ নেই। প্রেমে পড়ার বিষয় আশয় একই। মানে একজন পুরুষ যেমন হঠাৎ চকিতে প্রেমে পড়ে, নারীও পড়ে। তবে নারী তার প্রেমের কথা পুরুষের মত বলতে পারে না, সময় নেয়। এই সময় নেয়ার পেছনে কাজ করে সামাজিক ব্যবস্থা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যেহেতু অধীনস্থ, তাই সে তার পছন্দের কথা সহসা বলতে পারে না। নিজের ভেতরে রেখে নানা ছলের আশ্রয় নেয়। পুরুষকে সেটা বুঝে নিতে হয়। নারীর না এবং হ্যা ঠিক না এবং হ্যা নয়। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে, উভয়ের ক্ষেত্রেই আছে। কিন্তু প্রেমে পড়ে গেলে যেমন করেই হোক সুযোগ থাকলে তার ইচ্ছার কথা যেভাবেই হোক নারী পুরুষ উভয়েই বলবে। চকিতে কিংবা এক পলকে প্রেমে পড়লেও নারী কিংবা পুরুষ যার তার প্রেমে পড়ে না। কার প্রেমে পড়বে এটা তার সামাজিক অবস্থান আগে থেকেই তার পছন্দের রেখায় একটা ধারণা দিয়ে রাখে। অর্থাৎ সামাজিক শ্রেণী প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে গোপনে ভূমিকা রাখে। তবে এর ব্যতয় ঘটে। এই ব্যতয়ই প্রেমের অনিশ্চয়তাকে নির্দেশ করে এবং এটা প্রেমের একদিকে সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক উভয় দিকের সত্যকে তুলে ধরে। প্রেমে তাই যে কেউ যে কারোর সংগেই পড়তে পারে। প্রেম এই দিক থেকে বৈষম্যহীন এক প্রকৃত সাম্যবাদকে তুলে ধরে।

[৩] কিন্তু সমস্যা প্রেমে পড়া নিয়ে নয়, প্রকৃত সমস্যা শুরু হয় প্রেমে পড়ার পর থেকে। যখন তারা উভয় উভয়কে ভালোবাসি বলে ফেলে, সমস্যার শুরু তখন থেকেই। তখন অনিশ্চয়তা কেটে অন্য একটা স্তরে পৌঁছে যায় প্রেম, বলা যায় এটা প্রেমের দ্বিতীয় স্তর। এই সময় অনিশচয়তা কেটে গেলেও আরো বড় অনিশচয়তা এসে হাজির হয়। সব সময় হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করতে থাকে। এটা প্রেমের একটা ব্যক্তিত্বের দিক। এই হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। শুরু হয় একে অপরের প্রতি চোখে চোখে রাখার গোয়েন্দাগিরি। প্রতিটি মুহূর্ত যেন একে অপরের কাছে জানা থাকে এটির নিশ্চয়তা রাখতে উভয়ে তটস্থ থাকে। তবে অপেক্ষাকৃত যে সামান্য একটু কম ভালোবাসে, তার চাইতে যে বেশি ভালোবাসে তার হারাবার ভয় বেশি থাকে। প্রেমে এই কমবেশি থাকবেই, কখনো উভয়ে সমান ভালোবাসবে এমন দেখা যায় না। কিন্তু প্রকৃত প্রেম কোন হারাবার ভয়ে ভীত থাকে না, কারণ প্রেম একটা অনিশ্চিত জার্নি। প্রেম মানেই হচ্ছে ভবিষ্যৎ নয়, মুহূর্তকে উপভোগ করা। একে অপরের শারীরিক মানসিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করাই প্রেমের ধর্ম। এখানে পাওয়া মানে হচ্ছে সারাজীবনের জন্য পাওয়া। যখন প্রেমে এই বোধ কাজ করে তখন প্রেম শুকিয়ে যেতে শুরু করে। প্রেমের সময় কেউ যদি পাওয়ার জন্য বিয়ের কথা ভাবে, প্রেম সেখানেই মৃত্যু বরণ করে। প্রেম যদি হয় একটি প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ, বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি। আমাদের দেশে প্রেমিক প্রেমিকা খুঁজে পাওয়া ভার। কেউ প্রেমে পড়লেই তারা প্রথমেই বিয়ের কথা ভাবে। বিয়ে মানেই তার বুঝে সারাজীবনের জন্য পাওয়াকে। এই চিন্তা ভুল, বরং উল্টো। বিয়ে করলে প্রেমকে হারিয়ে ফেলতে হয়। প্রেম একটি খেলা। এখানে উভয়ে তার জৈবিকতাকে ব্যবহার করে, সংগে সাংস্কৃতিক শিল্পবোধ। প্রেমের সময় মানুষ সবচাইতে সুন্দর হয়, কারণ প্রেম কোন চুক্তি বা শর্তাধীন নয়। প্রেম একটি মুক্ত সম্পর্ক এবং এই সম্পর্কের প্রধান সৌন্দর্য হচ্ছে একে অপরকে ভালোবাসা এবং যত্ন করা। 

[৪] প্রেম যে কোন সময় ভেঙে যেতে পারে। এখানে কে দোষী কে নয়, তা বিবেচ্য নয়। যে কোন কারণে ভেঙে যেতে পারে। এখানে পুরুষ চরিত্র কিংবা নারী চরিত্র দায়ী নয়, দায়ী প্রেমের ধর্ম। যে কারণে প্রেম হয়, প্রেম হয়ে গেলে সেই কারণগুলি থিতিয়ে আসে, তখন প্রেমের যে সৌন্দর্য তা ভেঙে পড়ে। এই সময়ের পরে প্রেমে থাকা আর না থাকা একই কথা। উভয় উভয়ের কাছে তখন আর প্রথম দেখার মত সুন্দর লাগে না, কারণ ততদিনে সেই রহস্য কেটে গেছে। কিন্তু মানুষের শক্তি এখানেই যে সে আবার এবং বারবার প্রেমে পড়তে পারে। একজনের যা কিছু রহস্য কিংবা ভালোলাগার উপাদান, তা অন্যদের চাইতে আলাদা, ফলে মানুষ আবার প্রেমে পড়ে। আর একথা ঠিক যে মানুষ বদলে গেলেই দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি আবার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। প্রেম ভেঙে গেলে মানুষ মুষড়ে পড়ে। হতাশ হয়, কষ্ট পায়। মানসিক স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলে, কেউ কেউ আত্মহত্যাও করে। এটা কেন হয়? এটার কারণ মানুষটার না থাকার জন্য শরীরের অভ্যন্তরে যে পরিবর্তন হয়, তা তাকে বাধ্য করে এমন আচরণ করতে যা স্বাভাবিক নয়। একটা অভ্যেস তাকে যে ছন্দে ফেলেছিল, ভেঙে যাওয়ার পর সেই ছন্দ ভেঙে পড়ে, তখন মানুষ কষ্ট পায়, নানারকম অসুস্থ কাজ করতে থাকে। আর একটা জিনিস হয়, প্রেমে একে অপরের কাছাকাছি আসার ফলে শরীর ও মনের উপর একটা অধিকার গড়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। প্রেম ভেঙে গেলে শরীর এবং মনের অনুপস্থিতি তাকে প্রচণ্ড পীড়া দেয়। তখন সে অবর্ণনীয় কষ্ট অনুভব করে। তবে সময় সব কিছুকে স্বাভাবিক করে তোলে এবং এক সময় মানুষ আবার প্রেমে পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

[৫] প্রেম ভেঙে গেলে আমাদের এখানে প্রধানত পুরুষকে দায়ী করার প্রবণতা আছে। কেন এই প্রবণতা? কারণ আর কিছুই নয়, পুরুষাধিপত্য। ধরেই নেয়া হয় যে যে আধিপত্য করে, সেই ভাঙে। আসলে এখানে আধিপত্য নয়, ভাঙে প্রেমের স্বভাবের জন্যই। এখানে কে বেশি ভূমিকা নেয়, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যে কেউ নিতে পারে। আর একটা কারণ দেখানো হয় পুরুষ নারীদের তুলনায় অধিক বহুগামি। আসলে বহুগামিতা প্রাণীরই ধর্ম। প্রেম ভাঙার জন্য বহুগামিতা দায়ী নয়, দায়ী আগেই বলেছি প্রেমের ধর্ম। তৃতীয় কারণটি হলো অর্থনৈতিক। নারী যেহেতু এখনো এখানে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেনি, তাই প্রেম ভেঙে গেলে নারী আঙুল তোলে পুরুষের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার উপর। অর্থাৎ কোন নারী যদি স্বাবলম্বী হয, তাহলে এই শর্তটি আর থাকে না, তখন তার উপরও এই দায়টি বর্তায়। আসলে এটি প্রেম ভেঙে যাওয়ার কোন কারণ নয়, আসল কারণ প্রমের নিজস্ব ধর্ম। প্রেম কতদিন টিকবে এটা নির্ভর করছে প্রেমে পড়া দুটি মানুষের উপর। তবে মানুষের বৈশিষ্ট্য যেহেতু মোটাদাগে একই, তাই বলা যায় প্রেম বেশিদিন টেকে না। এটা যেমন দ্রুত পিকে উঠে, আবার তা দ্রুত নীচে নেমে আসে। প্রেম যদি টেনেটুনে বিয়েতে গড়ায়, সেদিনই তার মৃত্যু ঘটে। তখন তাদের নতুন সম্পর্ক হয়, সামাজিক সম্পর্ক-স্বামীস্ত্রী। এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন সম্পর্ক।

[৬] তবে বিয়ে একটি হিসেব নিকেষের বিষয়। বিয়ে যেহেতু একটি সামাজিক চুক্তি, তাই এখানে দেখতে হয় পরস্পরের স্বার্থ। উভয় পক্ষ চুলচেরা হিসেব নিকেষ করে তবেই বিয়ের পিড়িতে বসার শর্ত পূরণ হয়। এখানে স্বার্থ কাজ করে কারণ বিয়ের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সন্তান উৎপাদন এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার সৃষ্টি করা। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যবস্থা না থাকলে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভব হতো কি না সন্দেহ আছে। যখন এটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তখন বিয়ে থাকা না থাকার আলাদা কোনো গুরুত্ব থাকবে না। বিয়েতে যতই হিসেব নিকেষ করা হোক না কেন, সেটাও যে দীর্ঘদিন টিকে থাকবে এমন গ্যারান্টি নাই। যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। এই ভেঙে যাওয়া আর প্রেম ভেঙে যাওয়া এক নয়। এই ভাঙায় থাকে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। স্বার্থের এতোটুকু হেরফের হলে ভেঙে পড়বে। এটার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে স্বার্থ। এর কারণ ঐ যে বললাম ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা। সূতরাং বিয়ে খুব নিশ্চিত একটি বিষয় তা নয়। এখানে পুরুষ কিংবা নারীর খারাপ বা ভালোর বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে স্বার্থপরতা। যে ব্যবস্থার ভেতর এই উপাদানটি আছে, তা মানুষের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাবেই। এটা পুরুষ কিংবা নারীর আলাদা কোন বিষয় নয়। পুরুষের উচ্ছৃঙ্খলতা কিংবা বহুগামিতা কোন বড় ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হচ্ছে এর অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। যতদিন পর্যন্ত এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, বিয়ে ভেঙে পড়া ততদিন থাকবে। নারী অধঃস্তন বলে সে পুরুষের নানাবিধ দোষ দিয়ে যেতে থাকবে। কিন্তু আসল দোষ ব্যবস্থার।

[৭] জীবন অনিশ্চিতের পথে এক অনুপম যাত্রা। যদি কেউ এই অনিশ্চয়তার সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে না পারে কিংবা শেখে, তাহলে তার জীবন হবে ষোলআনা মিছে। সারাজীবন একে অপরকে দোষ চাপিয়ে বিবাদে লিপ্ত থেকে একদিন টুপ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। অথচ পৃথিবী হচ্ছে এমন এক রূপময় স্থান যার রূপ রস গন্ধ মেখে জীবনকে ধন্য করা যায়। চাই কলহমুক্ত একটি পৃথিবী, হে মানুষসকল। লেখক: কথাসাহিত্যিক

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়