আহসান হাবিব: [১] মহামতি সিগমুন্ড ফ্রয়েড যখন তার মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব উপস্থাপন করছিলেন তখন তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে এতে তার অনেক শত্রু বাড়বে। কথাটি সত্য। তার জীবিতকালে নয়, এখনো পৃথিবীতে তার অসংখ্য শত্রু। কেন? কারণ এই মনঃসমীক্ষণ ব্যক্তির মনস্তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিকভাবে তুলে ধরে। এতে ব্যক্তির নিজের মনস্তত্ত্বের নেতিবাচকতা প্রকাশ হয়ে পড়লে তাকে হীনমন্যতা পেয়ে বসে, ফলে এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে সে। এটাও সেই ব্যক্তির মানসকি দৈন্যের একটি বাস্তব উদাহরণ। [২] এটা তো গেলো মনস্তত্ত্বের কথা। এই দেশে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ নিয়ে যদি আলোচনা করা হয়, তাতেও এরা একইরকমভাবে ফুঁসে উঠে, এমনকি যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নিয়ে সংগ্রাম করে এমন দলগুলিও। এখানে মতাদর্শিক বিতর্কের কোনো স্থান আছে বলে মনে হয় না। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করাও এখানে বিপজ্জনক। কেননা এরা এক একটা খোপে বন্দী। নিজের খোপের মোরগগুলির ডাক অনেক সুমধুর কিন্তু অন্য খোপের মোরগগুলির ডাক কর্কশ। একদিকে পিঠ চুলকানি অন্যদিকে বিদ্রুপ বর্ষণ। নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা এখানে সোনার হরিণ।
আবার যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা করা হয়, তাহলে সেই বিতর্কে সুস্থ অংশগ্রহণ করা আশা করা হবে বাতুলতা। তখন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান একিভূত হয়ে একক ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এখনকার রাজনৈতিক দল এবং যে কোনো প্রতিষ্ঠান একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এমনকি যারা গণতন্ত্রের জন্য পাগল, তারাও নিজেদের প্রতিষ্ঠানে এক একজন হিটলার। এখানে আবার সাহিত্য সমালোচনা এবং মতাদর্শিক বিতর্ককে এক জায়গায় গুলিয়ে ফেলা হয়। সাহিত্যে দর্শন বিতর্ক হতে পারে, তবে তা একটি অংশ কিন্তু প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা ভিন্ন বিষয়। এই পার্থক্য এখানে অনেকেই করতে পারে না। [৩] মতাদর্শগতভাবে এখানে প্রতিষ্ঠানগুলি যা বলে করে তার উল্টা। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক বিশাল নেতার দলের কর্মসূচী ছিল ধর্ম, কর্ম, সমাজতন্ত্র। একদিকে ধর্ম এবং অন্যদিকে সমাজতন্ত্র যে দর্শনের দিকে থেকে পরস্পর বিপরীতধর্মী, তা সেই নেতার মাথায় ছিল না।
তিনি একদিকে এদেশের মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন, আবার প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের কথা সমাজতন্ত্র নামক শব্দ দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই হয়নি, এটা ছিল কাঁঠালেরআমসত্ত্ব। তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল বান্ডেল অব কন্ট্রাডিকশনে ভরা, ফলে ইতিহাস তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। [৪] আমাদের দেশে বহু লিটল ম্যাগাজিন বের হয়। তাদের একজন করে সম্পাদক থাকে আর থাকে লেখকগোষ্ঠী। এদের প্রধান শ্লোগান হলো প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা। লিটল ম্যাগাজিন নিজে এক একটি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তাদের বিরোধীতা ঐ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই। এখন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজের বিরুদ্ধে যেতে পারে না, ফলে তারা কার বিরোধীতা করে? তাদের চেয়ে যে প্রতিষ্ঠান বড় তার বিরোধীতা। তাদের চেয়ে সব বড় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র। তারা এর বিরোধীতা করে। রাষ্ট্র কি? রাষ্ট্র একটা শ্রেণির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান। যেমন আমাদের রাষ্ট্রটি পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া একনায়কত্বের অধীন, আবার বিলুপ্ত সোভিয়েত ছিল প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব।
তাহলে দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে লিটল ম্যাগাজিন দার্শনিকভাবে রাষ্ট্র মানে পুঁজিবাদ বিরোধী। খুব ভাল কথা। কিন্তু বাস্তবে কি দেখা যায়? দেখা যায় আমাদের এখানে লিটল ম্যাগাজিনের এক একজন সম্পাদক আবার পুঁজিপতি নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের হয় সাহিত্য সম্পাদক কিংবা রাষ্ট্রের অন্য কোনো পদে চাকরি করেন। অর্থাৎ একই অঙ্গে তিনি পুঁজিবাদ বিরোধী আবার পুঁজির দাস। এই স্ববিরোধীতা বা সেল্ফ কন্ট্রাডিকশন তারা বুঝতে পারে না। লেখকরাও একই, তারাও এই দ্বন্দ্ব বুঝতে অক্ষম, ফলে তারাও এই স্ববিরোধীতার অংশ হয়ে পড়ে সম্পাদক এবং লিটল ম্যাগাজিনের ভাড়াখাটা দাস হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদ বিরোধীতা একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম, লক্ষ্য এর দ্বন্দ্বটির মিমাংসা করা এবং পরবর্তী সমাজে রুপান্তরিত হওয়া। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে কি দ্বন্দ্ব বিরাজ করে, এটা না বুঝলে তো মতাদর্শগত বিতর্কের জায়গাটি শনাক্ত করা যাবে না।
পুঁজিবাদের প্রধান দ্বন্দ্ব হচ্ছে উৎপাদন এবং ভোগের বৈষম্যে। এখানে উৎপাদন সামাজিক কিন্তু ভোগ ব্যক্তিক। রূপান্তরের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এমন সমাজ নির্মাণ যেখানে উৎপাদন এবং ভোগ উভয়ই হবে সমাজিক। এখানে লোপ পাবে ব্যক্তিগত সম্পদের আত্মসাৎবৃত্তি। তাহলে একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দুই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিরোধীতাটি তিনি কার বিরুদ্ধে করবেন? ঐ যে ধর্ম কর্ম সমাজতন্ত্র, এটাও একই চরিত্রের অর্থাৎ স্ববিরোধীতা। আবার সামাজিক বিকাশ প্রসঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনওয়ালাদের একটি বক্তব্য হলো বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অসাধারণ গতির বিরুদ্ধে লিটল ম্যাগাজিনকে সমন্বিতরূপে দাঁড়াতে হবে। কি সাংঘাতিক আহ্বান। এই প্রসঙ্গে লেনিন পুঁজিবাদী বিকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নৈরাজ্যবাদী পেটিবুর্জোয়াদের সম্পর্কে বলেছিলেন নাকখাদা কুত্তাটার তেজ কত, মস্ত হাতীটারে দেখে কী ভীষণ গর্জায়-লেনিন একইভাবে এখানে দেখতে পাচ্ছি এইসব নাকখাদা লিটল লুম্পেনগুলি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অসাধারণ গতিকে ঠেকাতে নাকি সমন্বিতস্বরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবে। শুনলে হাসি ধরে রাখা দায়।
এরা সামাজিক বিকাশ এবং পুঁজিবাদবিরোধিতাকে একই কাতারে ফেলে দিয়েছে। এই মূর্খতা এখন এই দেশে বেশ চলছে। পুঁজির ভাড়াখাটা দাস পুঁজিবাদের বিরোধীতায় নেমে বিকাশকে রুদ্ধ করতে চাইছে। অথচ বিকাশই হচ্ছে মানবসমাজের মুক্তির একমাত্র পথ। এরা বৈষম্যকে বিকাশের সংগে গুলিয়ে ফেলে এক একজন নন্দলাল সেজে হুক্কাহুয়া দিয়ে চলেছে। এই নৈরাজ্যবাদের উৎস আর কিছু নয় ভারতীয় নকশাল আন্দোলনের পেটিবুর্জোয়া রোমান্টিকতা থেকে উদ্ভুত। কিন্তু ইতিহাস তার সমাজিবিকাশের বিজ্ঞান অনুসারে চলে, কোনো নৈরাজ্য বা রোম্যান্টিকতা দিয়ে চলে না। আছে এর বিজ্ঞানসম্মত কর্মসূচী এবং রণকৌশল।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :