প্রবীর বিকাশ সরকার: ঐতিহ্য হচ্ছে সংস্কৃতির পোশাকি নাম। সব সংস্কৃতি আবার ঐতিহ্য হয় না। বিদেশিচিন্তা বা বিদেশি জীবনযাত্রার প্রবল প্রভাবে গড়ে ওঠা ম্যানার, রীতিনীতি ঐতিহ্য হবে না। কিন্তু দেশি-বিদেশি মিলিয়ে গড়ে ওঠা সামাজিক ধ্যানধারণা মিশ্রসংস্কৃতি। সেটা ঐতিহ্যের রূপ পরিগ্রহ করবে। অর্থাৎ যে সকল রীতিনীতি, আচার-আচরণ, সৃজন, আয়োজন গভীরভাবে জাতীয়তাবোধের উদ্রেক করে, জাগিয়ে রাখে, আত্মপ্রসাদে আমোদিত করে সেই অনুভব বা বোধটাই সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক পরম্পরা। যা কিনা যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষ আত্মস্থ করে নেয় স্বতঃস্ফূর্ত ভালোলাগায়, ভালোবাসায় সেটাই সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতিকে পূর্বপুরুষের অতিঅমূল্য আধ্যাত্মিক সম্পদ হিসেবে ধরে রাখার কার্যকরী প্রচেষ্টাই ঐতিহ্য।
জাপানি জাতি প্রাচ্যের বহুপ্রাচীন এক জাতি। পূর্ব এশিয়ার চেয়েও প্রাচীন ভারতীয় প্রভাব জাপানে খালিচোখেই পরিদৃষ্ট হয়, যদি সেরকম দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ জাপানে আসেন। সমগ্র বাঙালির মধ্যে ১ শতাংশ লোকেরও সেই দৃষ্টি নেই। ভ্রমণ যে একটি শিক্ষামূলক জীবনকর্ম এ সম্পর্কে বাঙালির কোনো স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই। সেই দৃষ্টিবোধ না থাকার কারণে বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়ন রসাতলে গিয়েছে ব্রিটিশ আমলেই। শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের প্রধান লক্ষ্যই থাকে আধিপত্য বিস্তারকৃত দেশ বা অঞ্চলের সংস্কতিকে ধ্বংস করে দেয়া এবং হযবরল সংস্কৃতি প্রচলন করা। ভারত উপমহাদেশ তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭০ বছর আগে মেইজি যুগেই (১৮৬৮-১৯১২) ইহুদি-খ্রিস্টান শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বপুঁজিপতিরা জাপানকেও গ্রাস করার জন্য এমন কোনো প্রচেষ্টা নেই যা করতে বাকি রাখেনি। জাপানও উন্মুক্তভাবে পাশ্চাত সংস্কৃতি, রীতিনীতি, আচার, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তার পূর্ব পুরুষের মর্যাদাসম্পন্ন রীতিনীতি, সংস্কৃতি শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, কারিগরি এবং স্বদেশবোধকে অসম্মানিত করেনি। স্বদেশি-বিদেশি চিন্তা ও দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়েছে চিরাচরিত ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে। জাপানে কিছু সুন্দর, যা কিছু দৃষ্টিকে আরাম দেয়, হৃদয়ে সুখানুভূতি জাগায় সেটাই জাপানের নিজস্ব জিনিস। তার সঙ্গে বিদেশি রং মেশালেও কাঠামোর ক্ষেত্রে ঐতিহ্য প্রস্ফুটিত, আলোকিত।
জাপানি ঐতিহ্যের মূলে নাগরিকদের জাতীয়তাবাদ বা স্বদেশপ্রেম বিদ্যমান। সেখান থেকে এক চুলও তারা বিগত ৬০০০ বছরে সরে আসেনি। সত্যিই যদি জাপান থেকে কিছু আমদানি করতে হয় তাহলে তাদের সামাজিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া জরুরি। যার প্রথম শর্তই হচ্ছে ঐতিহ্য মেনেচলা এবং রক্ষাকরা। জাতীয়তাবাদের নানা রূপ ও সংজ্ঞা আছে কিন্তু তার লক্ষ্য একটাই হতে হবে ঐতিহ্যকে ধারণ করে সর্বপ্রকার উন্নয়ন সাধন করা। আমার বিগত ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে জাপান সম্পর্কে এই সত্যই আবিষ্কার করেছি। জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :