শিরোনাম

প্রকাশিত : ১০ জুলাই, ২০২৪, ১২:৫০ রাত
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৫:০০ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

লিটল ম্যাগাজিন : গালভরা গল্প

আহসান হাবিব

আহসান হাবিব: [১] পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে একটা লিটল ম্যাগাজিন আয়োজিত সাহিত্যসভায় গিয়েছিলাম। যেকোনো সাহিত্যসভা আমার প্রিয়। সভাটি যদি শুক্রবারে অনুষ্ঠিত হয়, যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। গত শুক্রবারেও এরকম একটি সাহিত্যসভায় গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান মিলনায়তনে। সেটা ছিল একটা প্রকাশনীর উদ্যোগে। ভারত থেকে এসেছিলেন কয়েকজন উত্তরাধুনিকতা বিষয়ক পন্ডিত। সাহিত্যসভার বিষয় ছিলো : চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং লিটল ম্যাগাজিনের সমন্বিত রূপ। খুব গালভারা বিষয়। একজন একটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক যিনি উত্তরাধুনিকতা বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ, তিনি ছিলেন এই বিষয়ের প্রধান বক্তা। ভাবলাম, দারুণ একটা বিষয় জানা যাবে। 

[২] কী পেলাম গিয়ে? এককথায় কিচ্ছু না। লিটল ম্যাগাজিন কী, কী তার ইতিহাস বহুশ্রুত সেটা শুনলাম আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কীÑ এ বিষয়ে কিছু কথা শুনলাম। দেখলাম প্রবন্ধকার এ বিষয়ক লেখা প্রধানত একজন লেখকের (বইটা আমার পড়া) বই থেকে বেশ কিছু কথা তুলে দিয়ে বিষয়টা তুলে ধরলেন। আরো কিছু কথা বললেন। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কী সম্পর্ক এবং এর সমন্বিত রূপইবা কেমন সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু পেলাম বলে মনে হলো না। একটা জিনিসই পেলাম তাহলো লিটল ম্যাগাজিন যেকোনো পরিস্থিতিতে তার লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবেÑ এমন দৃঢ় প্রত্যয় বাণী। লড়াইয়ের স্বরূপ কী? প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি মানবসমাজে কী প্রভাব রাখবে, তা না জেনেই কিংবা ধারণা করে লিটল ম্যাগাজিন তখনো প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা চালিয়ে যাবে ভাবতেই মন একদম দুলে উঠলো। আমার কল্পনাশক্তির প্রায় বারোটা বেজে যাবার যোগাড়। বস্তুকে প্রাণময় করে তোলার যে প্রযুক্তি, যা আপাতত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নামে চালু হয়েছে, সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিটল ম্যাগাজিন লড়বে-ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। 

[৩] এই যে শত শত লিটল ম্যাগাজিনগুলি বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়, তাদের প্রধান কথাই হচ্ছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। প্রতিষ্ঠান মানে প্রধানত রাষ্ট্র মানে ধরে নিলাম পুঁজিবাদ। আচ্ছা বলুন তো, লিটল ম্যাগাজিন পুঁজিবাদ কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কী ভূমিকা পালন করেছে এ যাবৎ? রাষ্ট্র কি তার অত্যাচার থামিয়ে দিয়েছে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক বা এর লেখকদের ভয়ে কিংবা বাম রাজনীতিতে তার কোন প্রভাব পড়েছে? আমার চোখে পড়েনি। বরং বিষয়টি উল্টা। এরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই তো দুরস্ত, পুঁজিবাদ আরও দীর্ঘ এবং শক্তিশালী করার কাজেই নিয়োজিত থেকেছে, এখনো আছে। কী করে? লিটল ম্যাগাজিন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটা ক্ষুদে মালিকানা সত্তাকে ধারণ করে। তার বিপরীতে আছে বড় বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, আছে বিবিধ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানায় বিভিন্ন মিডিয়া। তার মধ্যে পত্রিকা একটি। প্রতিটি পত্রিকায় আছে সাহিত্যের পাতা। লিটল ম্যাগাজিনগুলি এদের দুচোখে দেখতে পারে না। এই দেখতে না পারা কীসের লক্ষণ? পুঁজির দিক থেকে পাতিবুর্জোয়া এটিচুড। সাধারণত বড় পুঁজি এসব ছোট ছোট পুঁজিকে গিলে ফেলে কিন্তু ছোট ছোট পুঁজি তাদের স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই করে যার ফল এরা মনে করে পুঁজিবাদ বিরোধিতা, কিন্তু আসলে তা বিরোধিতা নয়, হয়ে ওঠে পুঁজিবাদ বিকাশের অন্তরায়। এই প্রক্রিয়া বর্তমান বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতেও ক্রিয়াশীল। এরা পেটিবুর্জোয়াদের রক্ষায় জীবনপাত করতে করতে এখন বিলুপ্তির পথে। একইভাবে লিটল ম্যাগাজিনগুলিও ক্রমে তাদের অস্তিত্ব  হারিয়ে ফেলার পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু পাতিবুর্জোয়া রোমান্টিকতার জের হিসেবে এখনো তারা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকগণ এক একটা হস্তশিল্পের মালিকদের মতো। কোনো রকমে টিকে থাকা। কিন্তু তাদের আশাঙ্কা আরো বড় মালিক হওয়া, পারে না, তখন তাদের অবদমিত বাসনা জেগে ওঠে এবং বিরোধিতার নামে হস্তমৈথুনে লিপ্ত হয়। বৃহদায়তন শিল্প ছাড়া যেমন সমাজ বিকশিত হবে না, ঠিক তেমনি লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে প্রতিষ্ঠানের একটি চুলও স্পর্শ করা যাবে না, সাহিত্যসৃষ্টি তো দুরস্ত। এদের বিলুপ্তি এখন সময়ের ব্যাপার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এই ক্ষুদে মালিকদের ফেলে দেবে ভাগাড়ে।

[৪] সভায়, আগেই বলেছি, অনেকে পথসভার মতো উচ্চকণ্ঠে লিটন ম্যাগাজিনকে টিকিয়ে রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। সম্পাদক সাহেব তো এতে মহাখুশি। তিনিও তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করার জন্য কথা দিলেন। সভা শেষ করে আড্ডা মেরে বাসায় ফিরলাম, বেশ রাতে। ফেসবুক খুলে দেখি সভার আয়োজক লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক আর একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে হাসিমুখে পোজ দিচ্ছেন, সামনের টেবিলে সাজানো দামি দামি খাবার। দামি হতেই হবে। কারণ সভাটি সোনারগাঁওয়ে আর এর আয়োজক সমাকাল পত্রিকা। সবাই জানেন, সমকাল পত্রিকা বাংলাদেশের একটি শিল্পগোষ্ঠীর সিস্টার কনসার্ন। তারা বড় পুঁজির মালিক। বড় পুঁজির কী কাজ আশা করি সবাই জানেন। যে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক একটু আগে যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তার জ্বালাময়ী বক্তব্য রেখে আসলেন, সেই তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের সভায় কব্জি ডুবিয়ে খেতে চলে গেছেন। সত্যি সেলুকাস। তবে আমি বিস্মিত হইনি। কারণ পাতিবুর্জোয়াদের কাজই হলো বুর্জোয়াদের পদলেহন। সম্পাদকের এই পদলেহন তারই বহিঃপ্রকাশ। আর সেই সভায় যে সব সাহিত্যিকদের দেখতে পাওয়া গেলো, তারাও বিভিন্ন সভায় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে গালভারা বক্তব্য দেয়। কী করুণ নির্লজ্জতা এসব লেখকদের। লেখকরা কীভাবে পুঁজিবাদবিরোধিতায় তাদের ভূমিকা রাখবে, সামান্য এই কৌশল জানে না। তারা শ্রেণিসংস্কৃতির পক্ষে সাহিত্য করতে পারে না। একধরনের পাতিরোম্যান্টিকতায় আচ্ছন্ন থেকে দিনগত পাপ ক্ষয় করে চলে। লেখক: কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়