তসলিমা নাসরিন: কলকাতা পৌরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের একখানা ভাষণ দেখলাম ফেসবুকের ভিডিওতে। টুপি পরা মুসলিমদের একটি সভায় তিনি বলছেন, যারা ইসলাম নিয়ে জন্মায়নি, তারা দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, যারা মুসলিম তারা জান্নাতে যাবে, কিন্তু যারা মুসলিম নয়, তাদের দুর্ভাগ্য তারা মুসলিম নয়, তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে, তাদের ভেতর ঈমাণ আনাতে পারলে আল্লাহ খুশি হবেন, অর্থাৎ অমুসলিমদের ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুসলিম বানাতে হবে, মুসলিম হলেই তারা জান্নাতে যেতে পারবে, নচেৎ নয়। তাঁর ভাষণ শুনে মুসলিমরা বেজায় খুশি, আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করেছে। আল্লাহু আকবর বলে ফিরহাদ হাকিমও চেঁচিয়েছেন। জাকির নায়েকও তো এমন কথাই বলতেন। অমুসলিমদের তিনি ইসলামে কনভার্ট করার সব রকম উদ্যোগ নিতেন।
ফিরহাদ হাকিম জোর গলায় বলেন তিনি সাম্প্রদায়িক নন, কারণ তিনি দুর্গা পূজা করেন, কালী পূজা করেন। তিনি ধুতি পরেন। তাহলে ধুতি পরে, টুপিটা না পরে তিনি কেন মুসলিমদের সভায় যান না, সেখানে গিয়ে কেন বলেন না তিনি দুর্গা পূজা করেন, কালী পূজা করেন? তা বললে তিনি মুসলিমদের হাততালি পাবেন না, সে কারণেই বলেন না? আর কী বললে হিন্দুদের হাততালি পাবেন, সেটাও ভাল জানেন। বোকা বানাচ্ছেন দুই সম্প্রদায়কে, নাকি দুই সম্প্রদায়কে নাচাচ্ছেন। আমি কলকাতায় বাস করি না, কলকাতার খবর খুব একটা রাখা হয় না। ফিরহাদ হাকিম আসলে কেমন মানুষ তা আমি, সত্যি বলতে কী, জানি না। তাঁকে দেখলে তো অসাম্প্রদায়িকই মনে হয়, কিন্তু মুসলিমদের সামনে তিনি যা বললেন তা তো কোনও ভাবেই অসাম্প্রদায়িক কারও ভাষণ হতে পারে না, যা বলেছেন তা একমাত্র কট্টর সাম্প্রদায়িকরাই বিশ্বাস করে এবং বলে। কট্টর সাম্প্রদায়িকরাই কিন্তু একসময় জিহাদিতে রূপান্তরিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের মধ্যে যে সেক্যুলার মুসলিম নেই, তা নয়। আমি নিজেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া অনেক অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, আধুনিক মনস্ক, বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মমুক্ত, মুক্তচিন্তক, এমনকি নাস্তিকও দেখেছি। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে কি সেইসব সভ্য শিক্ষিত অসাম্প্রদায়িক মানুষকে দলে আমন্ত্রণ জানাতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম রাজনীতির অবসান হোক। যার যা ধর্ম বিশ্বাস থাকুক, যার যা জেন্ডার থাকুক, কাস্ট থাকুক, যার যা বিত্ত থাকুক, শ্রেণি থাকুক, সকলকে মানুষ হিসেবে ট্রিট করা হোক।
আপনার মতামত লিখুন :