এম আমির হোসেন: [১] বড় বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সফল কোনো গণ-আন্দোলন বাংলাদেশে কখনও হবে না। কেননা যারা দুর্নীতির মূল ভুক্তভোগী তারাও নানান দুর্নীতিতে জড়িত কেউ ছোটো কিংবা মাঝারি দুর্নীতিতে জড়িত, কেউ স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় জড়িত। বিভিন্ন মাত্রার দুর্নীতিবাজদের মধ্যে এখানে গড়ে উঠেছে দীর্ঘদিনের এক মিথোজীবিতা। জনগণ ফুঁসে উঠলে উত্তাপে পানি ঢালার জন্য পিরিয়ডিক্যালি দুএকজন কুরবানি হবে মাত্র।
[২] বেশিরভাগ দুর্নীতিবাজই অভাবে দুর্নীতিবাজ। ছোটোখাটো দুর্নীতি ছাড়া তাদের পক্ষে রুটিরুজিসহ মৌলিক অধিকার পূরণ করা অত্যন্ত কঠিন। এটা সিস্টেমের ত্রুটি। এদের উপর যখন-তখন খড়গহস্ত না হয়ে অভাবটা দূর করে দিন। সিস্টেমকে ত্রুটিমুক্ত করুন। সবাই যেন মেধা ও যোগ্যতামতো স্ট্যান্ডার্ড লাইফ কাটাতে পারে সেই ব্যবস্থা করুন। যারা স্বভাবে দুর্নীতিবাজ শীর্ষ পর্যায়ে এমন হয়তো দশ বা বিশ হাজার আছে। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্তসহ সর্বোচ্চ শাস্তি দিন। দুর্নীতির এক টাকাও যেন দেশের বাইরে পাচার না হয় এই ব্যবস্থা নিন। এটাই হবে কার্যকরী উদ্যোগ। সমাজেও তখন আস্থা ফিরে আসবে।
[৩] বড় দুর্নীতির বড় কারণ দুর্নীতির সিন্ডিকেট। রাজনীতিজীবী, চাকরিজীবী এবং মিডিয়াজীবীদের সিন্ডিকেট না থাকলে হাজার কোটি টাকার এমন দুর্নীতি প্রায় অসম্ভব। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে প্রথম আঘাত নিজের ঘর থেকে শুরু করতে হবে।
[৪] বর্তমান সরকারের আগের স্লোগান ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ। সবাই ভেবেছিল সিস্টেম ডিজিটাল হলে দুর্নীতি কমে আসবে। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। দুর্নীতিবাজরাও সমানতালে ডিজিটাল হয়েছে। সরকারের বর্তমান স্লোগান স্মার্ট বাংলাদেশ। আশা করবো, সিস্টেমকে এবার এমন স্মার্ট বানানো হবে যেন দুর্নীতিবাজরা কখনও স্মার্ট দুর্নীতিবাজ-এ পরিণত হতে না পারে।
[৫] সমাজের মেধাবী যে শ্রেণিটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে দেখে তাদের চেয়ে অনেক কম যোগ্যতা নিয়ে একদল দুর্নীতিবাজ থানা, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, টেক্স অফিস, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি অফিস কিংবা ভূমি অফিসে চাকরি করে অগাধ ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে তারা তখন ডিমোরালাইজড হয়ে যায়। এরা হয়তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে না, কিন্তু নীরবে দেশ ছাড়ে কিংবা অভিমান নিয়ে নিজের পটেনশিয়ালকে অব্যবহৃত রেখে জীবন কাটিয়ে দেয়। এদের কথা কি কেউ ভাবে?
[৬] দুর্নীতি না কমালে একটা দেশ যে কতো দিকে কতো ভাবে লুজার হয় তা অনুধাবন করার মতো মাননীয় কর্তৃপক্ষ কি কেউ নেই আমাদের?
[৭] দুর্নীতির মনস্তাত্ত্বিক বড় কারণ ইনসিকিউরিটি। মৌলিক অধিকার, ভবিষ্যৎ ভাবনা, পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে আশঙ্কা আমাদের ইনসিকিউরড ফিল করায়। হঠাৎ যদি কর্মহীন হয়ে যাই কিংবা স্বাস্থ্যহানী ঘটে তবে আমাদের দায়িত্ব কে নিবে এই ভয় আমাদের তাড়িত করে। রাষ্ট্র কোনো দায়িত্ব নেয় না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ প্রতিটি মৌলিক অধিকার পকেটের টাকায় কিনতে হয়। বার্ধক্যকে নিরাপদ করার জন্য যৌবনে টাকা জমাতে হয়। পরবর্তী প্রজন্মকে নিরাপদে রাখার জন্য সম্পদ বানাতে হয়। ভবিষ্যৎ ভাবনায় নষ্ট হয় আমাদের বর্তমান। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে আমাদের সোশ্যাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক করতে হবে। রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। তখনই কেবল জীবন বেচে জীবিকা ও নিরাপত্তা অর্জনের দুষ্টচক্র থেকে আমরা বের হতে পারবো। দুর্নীতি করার প্রয়োজনই কমে যাবে। নিজের জীবন ও বর্তমান সময়কে সহজ করে উপভোগ করার পথ সৃষ্টি হবে। লেখক: চিকিৎসক
আপনার মতামত লিখুন :