যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ওই ঘোষণার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ থেকে আমদানি পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক বাবদ 'অতি সামান্য' পরিমাণ রাজস্ব আয় করেছে বাংলাদেশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক আদায় হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। যা ওই সময়ে পৃথিবীর সব দেশের আমদানি থেকে আদায় করা মোট রাজস্বের দুই শতাংশেরও কম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে—এই নয় মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে।
সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, এ সময়ে বৈশ্বিক আমদানি থেকে সামগ্রিক শুল্ক আদায় হয়েছে ৬৪ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের চিত্রও প্রায় একই ছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আদায় হয়েছিল এক হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। এটি আমদানি শুল্ক থেকে বাংলাদেশের মোট আয়ের প্রায় দেড় শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে আমদানি হয়েছে সাত লাখ দুই হাজার ২৩০ কোটি টাকার পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২৮ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এটি বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানির মাত্র চার শতাংশ।
এর আগে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মার্কিন পণ্য থেকে শুল্ক আদায় হয়েছিল এক হাজার ৩১৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ দুই হাজার ২০০-র বেশি পণ্য আমদানি করলেও মাত্র ১০ পণ্যে শুল্ক আদায় হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
এর মধ্যে মোটর গাড়িতে সর্বোচ্চ শুল্ক (টিটিআই) ছিল ১৫০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। রাসায়নিক উড পাল্পের ওপর সর্বনিম্ন শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশে সাড়ে সাত হাজারের বেশি শুল্ক ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে টিটিআই এক হাজার ২১ শতাংশ।
দামের দিক থেকে বড় ধরনের মার্কিন পণ্য আমদানির মধ্যে আছে ২০২ কোটি টাকার ফেরোস ওয়েস্ট ও স্ক্র্যাপ, ১১৮ কোটি টাকার সেলুলোজ অ্যাসিটেটের আর্টিফিশিয়াল ফিলামেন্ট টো ও ৫৫ কোটি টাকার কাঠবাদাম।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক আরোপ করার পর রাজস্ব বোর্ডে এই পর্যালোচনা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দাবি—বাংলাদেশ কার্যকরভাবে মার্কিন পণ্যের ওপর ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর এখন থেকে ৩৭ শতাংশ 'ডিসকাউন্টেড রেসপিপ্রোকাল ট্যারিফ' আরোপ করা হবে।
বর্তমানে আমদানি করা মার্কিন পণ্যের ওপর গড় (ওয়েটেড) শুল্ক প্রায় তিন শতাংশ।আমরা যদি সম্পূরক ও নিয়ন্ত্রক শুল্কের মতো অন্যান্য শুল্ক অন্তর্ভুক্ত করলে গড় শুল্ক সাড়ে তিন শতাংশের কাছাকাছি হবে। তুলা, সয়াবিন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম পণ্যসহ বেশ কয়েকটি মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা আছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর মোট কার্যকর শুল্ক পাঁচ শতাংশের নিচে।
তার মতে, যেহেতু বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর সঙ্গে যুক্ত, তাই তারা প্রায় এক ডজন পণ্য বেছে নিয়েছেন, যার ওপর আমদানি শুল্ক কমানো যেতে পারে।
কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর আমদানি কমিয়ে দেওয়া হলেও যদি ব্যবসায়ীরা মার্কিন পণ্য না আনেন তাহলে আমদানি বাড়বে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে গেলে সরকারি ক্রয় বিকল্প হতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক মার্কিন পণ্যের ওপর বাংলাদেশের ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের মার্কিন দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'ট্রাম্প-যুগের পারস্পরিক শুল্ক সূত্র সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক। এটি পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও মৌলিকভাবে ভুল।'
তিনি মনে করেন, শুধু শুল্ক কমানো হলে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি খুব বাড়বে না।
'যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র উত্পাদন খাতে প্রতিযোগিতামূলক নয়, কেবল শুল্ক কমিয়ে আমদানি খুব একটা বাড়ানো যাবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো খুবই কঠিন।'
একতরফা ছাড় দেওয়ার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি আরও বলেন, 'সব দেশের জন্য বাংলাদেশের শুল্ক কাঠামো আছে। আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আলাদা শুল্ক কাঠামো করি, তাহলে ভারত ও জাপানের মতো অন্যান্য দেশও একই অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা দাবি করতে পারে।'
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ১৫টি পণ্যের আমদানি বাড়ানোর সুপারিশ করতে পারে রাজস্ব বোর্ড। এর মধ্যে আছে প্লাস্টিক সামগ্রী, মূলধনী যন্ত্রপাতি, জেনারেটর, হিমায়িত মাংস, বৈদ্যুতিক বাল্ব ও তার।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, 'এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল এই ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারণ করা। আমরা আলোচনা করব—কীভাবে আমাদের যোগাযোগের খসড়া তৈরি করা যায় ও মার্কিন প্রশাসনকে ঠিক কী জানানো যায়।'
'বৈঠক থেকে ইতিবাচক ফলাফল আশা করা হচ্ছে। এই সরকার অত্যন্ত ব্যবসাবান্ধব। আমরা এমন উদ্যোগ নেব যা শুধু টেকসই হবে না বরং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাড়িয়ে দেবে।'
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, যদি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস প্রযোজ্য হয়, তাহলে তা থেকে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যাই হোক, এটি ডব্লিউটিও প্রবিধানগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এটি ইউরোপীয় ও এশীয় অংশীদারদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে।'
তিনি জানান, ইউএসটিআর অশুল্ক বাধাকে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এগুলো সংস্কার করা হলে রাজস্ব কমবে না।
তিনি মনে করেন, প্রতিরক্ষামূলক শুল্ক কাঠামো পুনর্নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেন, এর মধ্যে শুল্ক, আধা-শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমানোর ব্যবস্থা আছে।
তার মতে, রপ্তানি না কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য এ ধরনের সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ।