শিরোনাম
◈ বাংলাদেশেও ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা, সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান ◈ চট্টগ্রাম-কুনমিং ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা, কমছে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা ব্যয় ◈ ড. ইউনূসকে প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে: সারজিস আলম ◈ পোস্টার লাগানোর সময় ছাত্রদল নেতাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, আহত ৭ ◈ ঢাকা-বেইজিং এক চুক্তি, ৮ সমঝোতা ◈ শত কোটির সরকারি ফান্ড থেকে ৯৬ কোটি টাকা খরচ : স্নিগ্ধ ◈ বিতর্কের মুখে আইসিটির প্রসিকিউটর সিলভিয়ার নিয়োগ বাতিল ◈ চট্টগ্রামে আক্রোশ, অন্তঃকোন্দল, দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তার একের পর এক খুন আহত প্রায় ২ হাজার! ◈ চীনকে ভালো বন্ধু হিসেবে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ : প্রধান উপদেষ্টা ◈ বছরের প্রথম সূর্যগ্রহণ আসছে ২৯ মার্চ

প্রকাশিত : ২৬ মার্চ, ২০২৫, ১১:০২ দুপুর
আপডেট : ২৯ মার্চ, ২০২৫, ০১:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : এল আর বাদল

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে এখনো বিতর্ক কেন?

এল আর বাদল : এমন এক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এবার স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দলটি নিপীড়ন ও স্বৈরাচারী কর্মকা-ের অভিযোগে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত এবং দলটির শীর্ষ নেতাসহ বেশিরভাগ নেতা পালিয়ে রয়েছেন।

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে একপাক্ষিকভাবে উপস্থাপনের জোরালো অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। যার মাধ্যমে এককভাবে একটা দল বা একজন ব্যক্তিকে সব কৃতিত্বের অংশীদার করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা। তবে বাংলাদেশে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ নতুন নয়। সূত্র, বিবিসি বাংলা

ইতিহাসের নির্মোহ উপস্থাপন এদেশে কখনোই হয়নি বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। বরং ইতিহাস বর্ণনার নামে রাজনৈতিক বয়ান উপস্থাপনের হিড়িক দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে।

তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর রাজনৈতিক উপস্থাপন সবচেয়ে বেশি ঘটেছে পাঠ্যপুস্তকে। ফলে এক প্রজন্মের সাথে আরেক প্রজন্মের ইতিহাসের জানাশোনায় ফারাক তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, নিহতের সংখ্যা, যুদ্ধের সময় ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকার মত বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হতে দেখা গেছে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়েও এদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে বিতর্ক অব্যাহত।

বিতর্কের সূচনা কবে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র প্রকল্পের একজন গবেষক ছিলেন আফসান চৌধুরী। একাত্তরের ঘটনাবলী নিয়ে অনেকগুলো বইও লিখেছেন তিনি।

মি. চৌধুরীর মতে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয় বয়ানে উপস্থাপনের প্রবণতা শুরু হয় স্বাধীনতার পরপরই। আর যেসব বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক চলমান সেগুলোর আবির্ভাব হয় ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা- ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরে।

বাহাত্তর, তেয়াত্তর বা চুয়াত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা ও নেতৃত্ব বিষয়ে এসব বিতর্ক ছিল না। শেখ মুজিব রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। জিয়াউর রহমানের ঘোষণা মানুষ শুনেছে, তিনি যুদ্ধের একজন সামরিক নেতা ছিলেন, বলেন আফসান চৌধুরী।

শেখ মুজিবুর রহমান আর জিয়াউর রহমান একই পরিসরের মানুষ ছিলেন। তারা তো একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না,” যোগ করেন তিনি।

স্বাধীনতার পর থেকেই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও সুবিধাজনক অবস্থান থেকে ইতিহাসে প্রচার শুরু হয় বলে মনে করেন কোনো কোনো গবেষক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক মো. মজিবুর রহমানের গবেষণার ক্ষেত্র পাঠ্যপুস্তক।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ এমন ন্যারেটিভ তৈরি করলো মনে হয় যেন আওয়ামী লীগই সব করে ফেলেছে।

মুক্তিযুদ্ধ একটা জনযুদ্ধ ছিল। আরো অনেক দল মতের লোক ছিল। গণমানুষ ছিল যাদের কোন দল মত ছিল না, তাদের অবদান সেই ন্যারেটিভে অন্তর্ভূক্ত হয়নি, যোগ করেন অধ্যাপক রহমান।

নাগরিকদের কাছে দেশের ইতিহাসকে তুলে ধরার শক্তিশালী মাধ্যম পাঠ্যবই। প্রথম থেকেই ইনক্লুসিভ হিস্ট্রি (অন্তর্ভূক্তিমূলক ইতিহাস) টেক্সট বুকে আসেনি। পরে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় এসে তাদের মতো করে ন্যারেটিভটা দাঁড় করালো, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অধ্যাপক মজিবুর রহমান।

সময়ের সঙ্গে বদলায় ইতিহাস?

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বাঁক বদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইতিহাসের বর্ণনায়ও বদল ঘটেছে। স্বাধীনতার পর রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তিত হয় ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে হত্যার পর। গবেষকরা বলছেন, তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বয়ানেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে।

এরপর, জিয়াউর রহমানের হত্যাকা- ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতায় আরোহণ ও ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার সময়কাল জুড়েও ইতিহাসের বয়ান কোনো না কোনোভাবে একপাক্ষিকই থেকে যায়, বলেন অধ্যাপক মজিবুর রহমান।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে শেখ মুজিবের ভাষণ বা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর প্রচার সাধারণত দেখা যায়নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে সময়ে আবার কেবল আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের ভূমিকাই প্রাধান্য পায় সরকারি প্রচার-প্রচারণায়। তখন পাঠ্যপুস্তকে যেমন পরিবর্তন আনা হয়, তেমনি সরকারি গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যদের কর্মকা-ের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

এভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা যাওয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ইতিহাসের ভাষ্যে বদল আসতে থাকে।

সবশেষ আওয়ামী লীগ যে লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলো এই সময়টাতে ইতিহাসের রাজনৈতিকীকরণ বেশি হয়েছে, বলেন অধ্যাপক রহমান।

এমনকি এই সময়ে দলীয় নেতাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। একাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে বন্দি ছিলেন, তখন মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মো. মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারা যদি সেসময় ওই গুরু দায়িত্ব পালন না করতেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হত না।

কিন্তু, তাদের পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদ, সবার অভিযোগ যে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই চার নেতাকে ‘সঠিক মূল্যায়ন’ করা হয়নি।

২০০৩ সালে বিএনপি আমলে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার পদক দেয়া হলেও ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ আমলে সেই পদক প্রত্যাহার করা হয়। তবে ২০২৪ সালে গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেই পদক আবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

গত দেড় দশকে পাঠ্যবইসহ সর্বত্র শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের ভূমিকাকে বড় করে দেখানোর প্রচেষ্টা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক সরকারগুলো টেক্সটবুকটাকে দলীয় লিফলেটের মতো করে ব্যবহার করেছে কখনো কখনো। যেন সেগুলো কোনো দলীয় প্রচারমাধ্যম।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরেও সেই প্রবণতা চলমান রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না, বলছিলেন মি. রহমান।

আবার সরকার বদলের পর চলতি বছরের শুরুতে দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস নির্ভর বিষয়বস্তুতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে অন্তর্বর্তী সরকার।

বিশেষত, ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় আনা সংযোজন-বিয়োজন বিষয়টিকে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
পরিবর্তিত পাঠ্যসূচি নিয়ে শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

আফসান চৌধুরী বলেন, নতুন প্রজন্ম ইতিহাস যথাযথভাবে জানতে পারে না। কারণ, সরকার পরিবর্তন হলে নতুন করে ইতিহাস লেখা হয়।

‘ঐতিহাসিক নয়, রাজনৈতিক’

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলে আসা বিতর্ক জিইয়ে রাখার জন্য রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি ইতিহাসবিদদের দায়ও দেখেন অনেকে।

ইতিহাসবিদরা সুবিধাগত কারণে হোক, আর আদর্শের কারণে হোক দলগুলোর সঙ্গে মিশে গেছেন। ফলে দলীয় বয়ানই ইতিহাস হয়ে উঠেছে কারো কারো কাছে, বলছিলেন আফসান চৌধুরী।

তার মতে, বিতর্কগুলো আদতে কোনো ঐতিহাসিক আলোচনা নয়, নিছকই রাজনৈতিক আলোচনা। রাজনৈতিক কারণেই এর আবির্ভাব বলে মনে করেন এই গবেষক।

ব্যাপারটা এমনভাবে দেখা হয় যেন, প্রথম কে বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে তার মানে সেই আসল নেতা। এটা একটা জোলো(লঘু) বিতর্ক। বিভিন্নজন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করেছেন। এ বলে ও দেশ স্বাধীন হোক চায়নি, ও বলে এ পাকিস্তানের এজেন্ট  ব্যাখ্যা করেন মি. চৌধুরী।

এটা রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী মানুষের আলোচনার বিষয়, যোগ করেন তিনি। কিন্তু একটি দেশের স্বাধীনতার এত বছর পরও যে বিতর্ক চলছে, তার অবসান কোথায়?

এই রাজনৈতিক ঝগড়ার’ কারণে একাত্তরের ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি, মন্তব্য করে মি. চৌধুরী বলছেন, যতদিন দেশে এই ধরনের রাজনীতি থাকবে এই ধরনের বিতর্ক চলতেই থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়