মহসিন কবির: জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘যে অফিসাররা হাসিনার আদেশ মানেননি, তারা আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে কখনোই আপোষ করবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।’
আজ সোমবার রাত পৌনে দুইটার দিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডি থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ভিডিওটিতে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সেনা সদস্যদের বিভিন্ন ভূমিকার চিত্র দেখা যায়। এর ক্যাপশনে হাসনাত আরও লিখেন, ‘দেশপ্রেমিক অফিসাররা রাজি হয়নি ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালাতে। আমরা দেশপ্রেমিক সেনাদের ভালোবাসি।’
তিনি লিখেন, ‘যে অফিসাররা হাসিনার আদেশ মানেননি, তারা আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে কখনোই আপোষ করবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।’
এদিকে জানা গেছে, ছাত্রনেতাদের আগ্রহেই গত ১১ মার্চ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে বহুল আলোচিত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। হাসনাত আবদুল্লাহর দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন ব্যাপক আলোচনা চলছে ঠিক সেই মুহূর্তে সেনা সদর বিষয়টি সম্পর্কে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করল।
সেনা সদরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব। সেনা সদরের বক্তব্যের পর একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চলও) সারজিস আলম।
তিনি হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, সেনাপ্রধান নয়, আমাদের আগ্রহেই ওই দিনের বৈঠকটি হয়েছিল। সারজিস ছাড়াও দলটির অন্য নেতারা হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান তুলে ধরেছেন। যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমত আলোচনার ঝড় বইছে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ গতকাল বলেছেন, দুই মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বা হাসনাত আবদুল্লাহর যে কোনো একজন মিথ্যা বলছেন। এটা চলতে পারে না। এর আগে শুক্রবার এক ইফতার মাহফিলে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা উচিত হয়নি। এটা শিষ্টাচারবর্জিত।
হাসনাত ও সারজিসের স্ট্যাটাসের জের ধরে এনসিপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে স্পষ্টতই বিভাজন তৈরি হয়েছে। দলটির নেতা ছাড়াও রাজনৈতিক সচেতন অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা শুরু করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, দলটির যাত্রার শুরুতেই যদি কোনো ইস্যুতে এভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে তাহলে আগামী দিনে তাদের পথচলা কতটা সহজ হবে সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। প্রশ্ন আসছে দলটি সাধারণ জনগণের কাছে কতটুকু বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা নতুন দল গঠন করেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের ভেতরে মতের অমিল রয়েছে- এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটাতে আমি খুব একটা সমস্যা মনে করছি না। অন্য রাজনৈতিক দলে এ ধরনের পরিস্থিতি হলে হয়তো একে অন্যকে বহিষ্কার করে দিত। এদের মধ্যে সেটা দেখা যায়নি। নতুন দল হিসেবে তাদের সময় দিতে হবে। দলের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা নিয়ে এখনো মন্তব্য করার সময় আসেনি।
উল্লেখ্য, ১১ মার্চ সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দেন। ওই স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন : ১১ মার্চ, সময় দুপুর ২:৩০। কিছুদিন আগে আমি আপনাদের বলেছিলাম যে, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। আমিসহ আরো দুজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। অবশ্য বৈঠকটি কার সঙ্গে হয়েছিল হাসনাত তার স্ট্যাটাসে স্পষ্ট করেননি।
হাসনাতের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সুইডেনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ‘নেত্র নিউজ’ সেনা সদরের বক্তব্য তুলে ধরেছে। ওই বক্তব্যে বলা হয়, সেনানিবাসে খোদ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেই ১১ মার্চ বৈঠকটি হয়েছিল। তবে হাসনাত আব্দুল্লাহকে ‘ডেকে নিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে তাদের প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগের অভিযোগ সঠিক নয়। বরং হাসনাত আব্দুল্লাহ ও তার দলের আরেক মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের আগ্রহেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল।’
সেনাসদর বিবৃতিতে বলেছে, ওই পোস্ট সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বৈ অন্য কিছু নয়। পোস্টটি অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার। হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য ইচ্ছা পোষণ করছিলেন। পরবর্তী সময়ে সারজিস আলম ১১ মার্চ সেনাপ্রধানের মিলিটারি এডভাইজারকে ফোন দিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সময় চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিলিটারি অ্যাডভাইজার তাদের সেনাসদরে আসার জন্য বলেন। অতঃপর ১১ মার্চ দুপুরে সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনাসদরে না এসে সরাসরি সেনাভবনে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেন। পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান অফিস কার্যক্রম শেষ করে সেনা ভবনে এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেন। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি কোনোক্রমেই তাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে তাদের প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগ করার ঘটনা নয়।
এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠিত সুশৃঙ্খল বাহিনীর প্রধান সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের যুগ্ম সংগঠকদের ডেকে নিয়ে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন বা চাপ প্রয়োগ করছেন যা অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার বলে প্রতীয়মান।
সেনাসদরের বক্তব্যে বলা হয়, এই দুই ছাত্র সমন্বয়ককে সেনাবাহিনী প্রধান ‘অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে ছেলের’ মতো দেখতেন। বিবৃতিতে বলা হয়, তিনি স্নেহবৎসল পরিবেশে তাদের সঙ্গে নানা আলাপচারিতা করেন।
হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সেনা সদরের বিবৃতির পরপরই তার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে পোস্ট দেন দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। গতকাল রোববার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে পোস্টে সারজিস লেখেন, মানুষ হিসেবে যে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির অভিমতকে একেকজন একেকভাবে অবজার্ভ করে। হাসনাত সেদিন তার জায়গা থেকে যেভাবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে অবজার্ভ ও রিসিভ করেছে এবং ফেসবুকে লিখেছে আমার সে ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিমত আছে।
সারজিস লেখেন, সেদিন আমি ও হাসনাত সেনাপ্রধানের সঙ্গে গিয়ে কথা বলি। প্রথমেই স্পষ্ট করে জানিয়ে রাখি, সেদিন সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি বরং সেনাপ্রধানের মিলিটারি অ্যাডভাইজারের সঙ্গে যখন প্রয়োজন হতো তখন ম্যাসেজের মাধ্যমে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা ও উত্তর আদান-প্রদান হতো। যেদিন সেনাপ্রধান পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিবসে অনেকটা কড়া ভাষায় বক্তব্য দিলেন এবং বললেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ’। তখন আমি সেনাপ্রধানের মিলিটারি অ্যাডভাইজারকে জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের দৃষ্টিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখছেন কিনা? সেনাপ্রধানের বক্তব্য তুলনামূলক স্ট্রেইট-ফরওয়ার্ড এবং হার্স মনে হচ্ছে। তিনি আমাকে বললেন, তোমরা কি এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে চাও? আমি বললাম, বলা যেতে পারে। এরপরে সেদিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। সেনাভবনে সেই রুমে আমরা তিনজনই ছিলাম। সেনাপ্রধান, হাসনাত ও আমি।
সারজিস আরো লেখেন, আমার জায়গা থেকে আমি সেদিনের বক্তব্যকে সরাসরি প্রস্তাব দেওয়ার আঙ্গিকে দেখি না বরং সরাসরি অভিমত প্রকাশের মতো করে দেখি। ‘অভিমত প্রকাশ’ এবং ‘প্রস্তাব দেওয়া’ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যদিও পূর্বের তুলনায় সেদিন সেনাপ্রধান অনেকটা স্ট্রেইট-ফরওয়ার্ড ভাষায় কথা বলছিলেন। পাশাপাশি রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের জন্য ‘চাপ দেওয়ার’ যে বিষয়টি এসেছে, সেখানে ‘চাপ দেওয়া হয়েছে’ এমনটি আমার মনে হয়নি। বরং রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ না এলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে, সেটা তিনি অতিআত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছিলেন।
সারজিস লেখেন, হাসনাতের বক্তব্যে যে টপিকগুলো এসেছিল, যেমন- রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ, সাবের হোসেন, শিরীন শারমিন চৌধুরী, সোহেল তাজ; এসব নিয়ে কথা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে কি না, এই ইলেকশনে আওয়ামী লীগ থাকলে কী হবে, না থাকলে কী হবে, আওয়ামী লীগ এই ইলেকশন না করলে কবে ফিরে আসতে পারে কিংবা আদৌ আসবে কি না, এসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল। এসব সমীকরণে দেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে, স্থিতিশীলতা কিংবা অস্থিতিশীলতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, সেসব নিয়ে কথা হয়েছিল। কিন্তু যেই টোনে হাসনাতের ফেসবুক লেখা উপস্থাপন করা হয়েছে, আমি মনে করি কনভারসেশন ততটা এক্সট্রিম ছিল না। তবে অন্য কোনো একদিনের চেয়ে অবশ্যই স্ট্রেইট-ফরওয়ার্ড এবং সো কনফিডেন্ট ছিল। দেশের স্থিতিশীলতার জন্য রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের ইলেকশনে অংশগ্রহণ করা যে প্রয়োজনীয়, সে বিষয়ে সরাসরি অভিমত ছিল।
তিনি আরো লেখেন, হাসনাত তার বক্তব্যে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করেছে, ‘আলোচনার একপর্যায়ে বলি- যে দল এখনো ক্ষমা চায়নি, অপরাধ স্বীকার করেনি, সে দলকে আপনারা কীভাবে ক্ষমা করে দেবেন!’ অপর পক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে, ‘ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর অ্যাটলিস্ট ফোরটি ইয়ারস। তোমার বয়সের থেকে বেশি।’ এই কনভারসেশনটা হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু আমাদের রুমে বসে হওয়া কনভারসেশন হঠাৎ এককভাবে শেষ করে যখন সেনাপ্রধান উঠে দাঁড়ালেন এবং রুম থেকে কথা বলতে বলতে বের হয়ে এসে যখন আমরা গাড়িতে করে ফিরব, তার আগে বিদায় নেওয়ার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই কনভারসেশন হয়েছে। সেনাপ্রধান রেগে যাওয়ার সুরে এ কথা বলেছেন বলে আমার মনে হয়নি বরং বয়সে তুলনামূলক বেশ সিনিয়র কেউ জুনিয়রদের যেভাবে অভিজ্ঞতার ভারের কথা ব্যক্ত করে, সেই টোন এবং এক্সপ্রেশনে বলেছেন।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি, অন্যান্য রাজনৈতিক দল কিংবা জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করানো প্রাসঙ্গিক নয় উল্লেখ করে সারজিস বলেন, ‘হাসনাত না ওয়াকার’ এই ন্যারেটিভ এবং স্লোগানকে আমি প্রত্যাশা করি না। হাসনাতের জায়গা ভিন্ন এবং সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের জায়গাও ভিন্ন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি অন্যান্য রাজনৈতিক দল কিংবা জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করানো কখনো প্রাসঙ্গিক নয়। পাশাপাশি সেনাপ্রধানের পদত্যাগ নিয়ে যে কথা দুয়েক জায়গায় আসছে, সেটিও আমাদের বক্তব্য নয়।
তিনি বলেন, এসবের পাশাপাশি আমি আমার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে একটি অভিমত প্রকাশ করতে চাই। আমি ভুল হতে পারি কিন্তু এই মুহূর্তে আমার এটিই সঠিক মনে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ না কেউ যোগাযোগ রক্ষা করে। সেই প্রাইভেসি তারা বজায় রাখে। আমাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের সরাসরি দ্বিমত থাকলেও আমরা সেগুলো নিয়ে আমাদের দলের ফোরামে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারতাম, সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম, সে অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারতাম কিংবা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের যেকোনো ভার্সনের বিরুদ্ধে এখনকার মতোই রাজপথে নামতে পারতাম অথবা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি আমাদের সঙ্গে ঐকমত্যে না পৌঁছলে আমরা শুধু আমাদের দলের পক্ষ থেকেই এই দাবি নিয়ে রাজপথে নামতে পারতাম।
কিন্তু যেভাবে এ কথাগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে, এ প্রক্রিয়া আমার কাছে সমীচীন মনে হয়নি। বরং এর ফলে পরবর্তী সময়ে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে। আমার এ বক্তব্য আমার সহযোদ্ধা হাসনাতের বক্তব্যের সঙ্গে বেশকিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত এসেছে। এটার জন্য অনেকে আমার সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ব্যক্তিত্ব স্রোতে গা ভাসানোর মতো কখনই ছিল না। ছিল না বলেই আমরা হাসিনা রেজিমের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম।
কেউ হাসনাতের দিকে বন্দুক তাক করলে আজও তার সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কমিটমেন্ট আছে জানিয়ে সারজিস লেখেন, সহযোদ্ধার কোনো বিষয় যখন নিজের জায়গা থেকে সংশোধন দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি, তখন সেটাও আমি করব। সেই বিবেকবোধটুকু ছিল বলেই ৬ জুন প্রথম যেদিন শহীদ মিনারে কয়েকজন কোটা প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, তাদের মধ্যে সামনের সারিতে আমরা ছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, এই বিবেকবোধের জায়গাটুকুই আমাদের সঠিক পথে রাখবে। আত্মসমালোচনা করার এই মানসিকতাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে যাবে। জুলাই গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটানো ‘আওয়ামী লীগের যেকোনো ভার্সনের’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।
এদিকে সারজিস আলমের বক্তব্যের পর এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেছেন, দুই মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বা হাসনাত আবদুল্লাহর যেকোনো একজন মিথ্যা বলছেন।
সারজিসের ফেসবুক পোস্টের মন্তব্যের ঘরে হান্নান মাসুদ লেখেন, ‘এসব কী ভাই। পাবলিকলিই বলছি- দুজনের একজন মিথ্যা বলছেন। এটা চলতে পারে না। আর দলের গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট হোল্ড করেও আপনারা যেভাবে ব্যক্তিগতভাবে বিচরণ করছেন এবং তা পাবলিক করে এনসিপিকেই বিতর্কিত করছেন। মানুষ এনসিপিকে নিয়ে যখন স্বপ্ন বুনছে, তখন এভাবে এনসিপিকে বিতর্কিত করা কাদের এজেন্ডা? সরি, আর চুপ থাকতে পারলাম না।’
এর আগে গত শুক্রবার এক ইফতার মাহফিলে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, হাসনাত আবদুল্লাহ রাষ্ট্রের যে বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে মিটিং করেছেন, তার এই বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা উচিত হয়নি। আমরা মনে করি এটা শিষ্টাচারবর্জিত স্ট্যাটাস হয়েছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ফাংশনারি আছে। আমরা দেখছি ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন ব্যক্তি রাজনৈতিক জায়গায় হস্তক্ষেপ করছেন। এ ধরনের হস্তক্ষেপ কাম্য নয় আমাদের কাছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নেবেন। সেখানে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিবর্গ জড়িত না হওয়ার জন্য আমরা অনুরোধ করছি।’
সেনা সদরের বিবৃতি এবং সারজিসসহ এনসিপির অন্য নেতাদের বক্তব্যের ব্যাপারে হাসনাত আবদুল্লাহর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, এই মুহূর্তে দলের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য নেই। দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পর আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব।