ডেস্ক রিপোর্ট : বাংলাদেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে চলমান প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মধ্যেই এসব মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করার জন্য বিদ্যমান আইনে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এক্ষেত্রে মামলার তদন্ত ও বিচার শেষ করার জন্য বর্তমান আইনে যে সময়সীমা রয়েছে, সেটি কমিয়ে অর্ধেক করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বর্তমান আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচারকাজ শেষ করার বিধান রয়েছে। সেটি কমিয়ে ৯০ দিন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সূত্র: বিবিসি বাংলা
বিচারের জন্য আগে যে সময় ছিল তা অর্ধেক করে দিচ্ছি, ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের মামলায় বিচার করতে হবে। ১৫ দিনের তদন্ত কাজ শেষ করতে হবে,” শনিবার সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন অধ্যাপক নজরুল। অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিগগিরই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা। সরকারের এই উদ্যোগকে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
তবে আইন পরিবর্তন করা হলেও সেটি বাস্তবায়ন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার নিশ্চিত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
বর্তমানে তারা যেখানে ১৮০ দিনের মধ্যেই মামলার বিচার শেষ করতে পারছে না, সেখানে ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করবে কীভাবে? বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান।
কেবল সময় কমিয়ে বা সময় বাড়িয়ে এটার সমাধান করা যাবে না। সমাধান করতে হলে মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচারের প্রতিটি ধাপে বিষয়টাকে আন্তরিকভাবে দেখতে হবে, বলেন মি. খান। এছাড়া তদন্তের সময় কমানোর ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
ধর্ষণ মামলার বিচার নিশ্চিত করার জন্য যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়, সেই বিবেচনায় তদন্তের সময়টি খুবই অপ্রতুল হবে। এটা ইমপ্রাকটিক্যাল (বাস্তবসম্মত নয়), বিবিসি বাংলাকে বলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম।
আইন পরিবর্তনের বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় একশ’ ছুঁয়েছে।
এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে কমপক্ষে ৪২টি। ফেব্রুয়ারিতে সেটি বেড়ে ৫৭-তে এসে ঠেকেছে। এর মধ্যে অন্তত দুই জন নারী ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন বলেও জানাচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনটি।
শিশুরাও এ ধরনের সহিংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত দুই মাসে কমপক্ষে ২৫টি শিশু ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহে মাগুরায় আট বছরের এক শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, যা নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধনের আয়োজন করেন বিক্ষুব্ধরা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে শনিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সেখানে তিনি জানান যে, ধর্ষণ মামলায় ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত এবং ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার জন্য আইন পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার।
স্টেকহোল্ডারদের সাথে কিছুটা পরামর্শ করে, তারপর ফাইনালাইজ করবো। আমরা চেষ্টা করবো, কয়েকদিনের মধ্যে আইনগত পরিবর্তন আনার জন্য,” সাংবাদিকদের বলেন অধ্যাপক নজরুল। অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ শেষে শিগগিরই আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করা হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।
বার বার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তনের ফলে ধর্ষণ মামলার তদন্তে যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সংশোধনের প্রস্তাবনায় সেটিও বিবেচনা করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা ৩০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে তাকে পরিবর্তন করায় মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক দেরি হয়ে যেত। আমরা ইনশাহআল্লাহ যে সংশোধনী আনবো, সেখানে বলবো (তদন্তের দায়িত্ব) যাকে দেওয়া হয়েছে, নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাকেই সম্পন্ন করতে হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা যাবে না, সংবাদ সম্মেলনে বলেন অধ্যাপক নজরুল।
এছাড়া মামলা চলাকালে অভিযুক্তদের যেন জামিন মঞ্জুর না করা হয়, সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দেওয়া থাকছে সংশোধনীর প্রস্তাবনায়। আগে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার না হলে জামিন দেওয়া যেতো, এখন কোনো জামিন দেওয়া হবে না ধর্ষণের মামলায়, বলেন আইন উপদেষ্টা।
ধর্ষণের মামলার তদারকিতে আইন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সেল গঠন করা হচ্ছে বলেও জানান উপদেষ্টা। সেই সঙ্গে এটাও জানান যে, যৌন নিপীড়নের বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ ও তদারকিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আরেকটি বিশেষ সেল তৈরি করতে যাচ্ছে সরকার।
চ্যালেঞ্জ কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণ মামলার আইন সংশোধন করাই অর্ন্তবর্তী সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
কারণ এখন যেহেতু সংসদ নেই, সেজন্য রাষ্ট্রপতিকে এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। ফলে রাষ্ট্রপতি যদি জরুরি মনে না করেন, সেক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি নাও করতে পারেন, বলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম। আবার কেবল আইন পরিবর্তন করেই দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব না বলেও জানাচ্ছেন মি. করিম।
বাংলাদেশে আমরা আগেও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে সেটি খুব একটা কাজে আসেনি, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. করিম। বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করে মি. করিম বলেন, এর আগে, ২০২০ সালে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে আইন করা হলো। কিন্তু তাতে কি দেশে ধর্ষণের ঘটনা কমেছে? কমেনি। ফলে আইন করার চেয়ে, সেটি বাস্তবায়নই সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
বাস্তবায়ন না করতে পারলে হাজারটা আইন থেকেই কোনো লাভ হবে না। আর এখন যেভাবে আইন পরিবর্তন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি কতটুকু সম্ভব হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, বলেন মি. করিম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, আইনে সময় বেঁধে দেওয়া হলেও সর্বক্ষেত্রে সেটি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নেই।
১৫ দিনে তদন্ত বা ৯০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার যে প্রস্তাবের কথা বলা হচ্ছে, সেটি আসলে একটি ডাইরেকটিভ, বাধ্যতামূলক নয়, বলেন আইনজীবী মি. করিম।
উল্লেখ্য যে, বর্তমান আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচারকাজ শেষ করার বিধান রাখা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলতে দেখা যায়। তেমনই একটি আলোচিত মামলা হলো সিলেটে এমসি কলেজে তরুণী ধর্ষণের মামলা।
২০২০ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বরে সংঘটিত ওই ধর্ষণ মামলা তদন্তের পর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগ গঠন করে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ডিএনএ পরীক্ষা করে মামলার চার আসামির সঙ্গে ডিএনএ ম্যাচিংও পাওয়া যায়। তারপরও মামলার বিচার শেষ হয়নি। একইভাবে, ২০১৬ সালে কুমিল্লায় সংঘটিত তনু হত্যা মামলার বিচারও শেষ হতে দেখা যায়নি।
সুতরাং কেবল আইনে সময় বেঁধে দিলেই হবে না। এই সময়ের মধ্যে যদি তদন্ত বা বিচারকাজ শেষ না হয়, তাহলে সেটার কনসিকোয়েন্স বা পরিণতি কী হবে? সেটা যদি স্পষ্টভাবে বলা না থাকে, সেক্ষেত্রে এটা সবাই মানবে না, বলেন মি. করিম।
জামিন বন্ধ হবে?
ধর্ষণের আসামিকে জামিন না দেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটিও বাস্তবসম্মত নয় বলে জানাচ্ছেন এই আইনজীবী। কারণ আদালত যুক্তিযুক্ত মনে করলে যেকোনো মামলায় আসামিকে জামিন দিতে পারেন। এমনকি হত্যা মামলার ক্ষেত্রেও আমরা আসামি জামিন পেতে দেখি,বলেন মি. করিম।
অন্যদিকে, তদন্তকারী কর্মকর্তারা আন্তরিক না হলে আইন পরিবর্তন কোনো কাজে আসবে না বলে জানাচ্ছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাবে বর্তমানে ১৮০ দিনের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে, বিচারকাজ শেষ হচ্ছে না। ফলে তারা আন্তরিকভাবে কাজ না করলে ধর্ষণ মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব না, বিবিসি বাংলাকে বলেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান।
এক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। দক্ষ কর্মকর্তা গড়ে তুলে তাদেরকে স্বাধীনভাবে তদন্ত করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তাহলে বিচার নিশ্চিত হবে, বলেন মি. খান।