মহসিন কবির: জনমনে শৃঙ্খলা ফেরাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং সার্বিক পরিস্থিতি আরো উন্নত করতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটি।
ওই সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হলো-
১. রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তল্লাশিচৌকি বাড়াতে হবে। অপরাধ প্রবণ এলাকায় টহল সংখ্যা বাড়ানো হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, বিজিবি সদস্যদের সমন্বয়ে যৌথবাহিনী গঠন করে টার্গেট এলাকায় জোরদার অপারেশন পরিচালনা করা হবে। ২. রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে নৌবাহিনীর একটি অতিরিক্ত পেট্রোল এবং কিছু এলাকায় কোস্ট গার্ডের একটি অতিরিক্ত পেট্রোল নিয়োজিত থাকবে।
৩. পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট প্রধান, উপ-পুলিশ কমিশনার, সেনাবাহিনীর মাঠে নিয়োজিত ব্রিগেড প্রধান ও অন্যান্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে সময়ে সময়ে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করবেন। ৪. ডিএমপির পুলিশ সদস্য, বিজিবি, আনসার ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সদস্যদের জন্য মোটরসাইকেল ক্রয় করা হবে, যাতে করে তাৎক্ষণিকভাবে অলিগলিতে টহল দিয়ে অপরাধীদের পাকড়াও করা যায়।
৫. ছিনতাইকারী ও ডাকাতরা অবস্থান করতে পারে এমন সম্ভাব্য স্থানগুলোতে কম্বাইন্ড অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। ৬. ঢাকা শহরের বাইরে, বিশেষ করে টঙ্গি, বছিলা, কেরানীগঞ্জ এবং মুন্সিগঞ্জ এলাকায়ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়ানো হবে।
৭. ৫০০ এপিবিএন সদস্য ডিএমপিতে ন্যস্ত হয়ে পুলিশের সঙ্গে কাজ করবে।
৮. থানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের হালনাগাদ তালিকা করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আইনের আওতায় আনতে তড়িৎ পদক্ষেপ নেবে। ৯. মিথ্যা, গুজব ও প্রোপাগান্ডার বিপরীতে সত্য তথ্যগুলো প্রচারে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে কোর কমিটির এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মকর্তাদের চলমান আন্দোলন ও উসকানিমূলক কার্যক্রম মোকাবিলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানের মধ্যেই ঘরে ঢুকে গুলি করছে ডাকাতদল। রাতে কাজ শেষে ঘরে ফেরা ব্যবসায়ী কিংবা পথচারীর টাকা ও মূল্যবান জিনিস অস্ত্রের মুখে ছিনিয়ে নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। তালা কেটে বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল লুটপাট নিত্যদিনের ঘটনা। লুটপাটে বাধা পেলেই এলোপাতাড়ি কোপানো হচ্ছে, শরীর বরাবর চালানো হচ্ছে গুলি। ঘরে ঢুকে চুরি-ডাকাতি এবং রাস্তায় ছিনতাইয়ের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ। শহর থেকে গ্রামগঞ্জে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
ডিএমপির উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গতকাল সোমবার গণমাধ্যমকে বলেন, ডিএমপির প্রত্যেকটি থানায় টহল বাড়ানো হয়েছে। যৌথ বাহিনীর চেকপোস্টে কড়া তল্লাশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সিটিটিসিসহ পুলিশের যেসব ইউনিট সাধারণত এই ধরনের অপারেশনে থাকে না, তাদেরও মাঠে নামানো হয়েছে। বৃদ্ধি করা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যৌথ বাহিনীর অভিযানের মধ্যেই রবিবার রাতে বনশ্রীতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২০০ ভরি স্বর্ণ লুট এবং একই রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুরসহ একাধিক স্থানে লোমহর্ষক ছিনতাইয়ের পর টহল ও চেকপোস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। র্যাব, পুলিশ ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের যৌথ অভিযানের কথাও জানিয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। দেশ থেকে লুট করা অর্থের ফেরত এনে বিশৃঙ্খলা তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, রাতে ছিনতাই বেড়েছে। দিনেও ছিনতাই বেড়েছে। ছিনতাই প্রতিরোধে সোমবার থেকে মেট্রোপলিটন পুলিশ, র্যাব ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট যৌথ অভিযান পরিচালনা করবে। আমরা দেখি এভাবে উন্নতি হয় কিনা। না হলে আমাদের অন্য পরিকল্পনায় যেতে হবে। তিনি বলেন, একটি গোষ্ঠী চায় না বাংলাদেশে স্মৃতিশীল পরিবেশ বজায় থাক। সেটার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
রাজধানী বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত রোববার রাত রাজধানীবাসীর চরম আতঙ্কে কাটছে। রাত ৮টার দিকে ধানমন্ডি এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হয়, ‘চুরি-চাপাতি নিয়ে মহল্লায় ডাকাতদল ঢুকছে। আমরা সকলে সতর্ক থাকি।’ এই ঘটনার আতঙ্ক না কাটতেই রাত সাড়ে ১০টার দিকে বনশ্রী এলাকায় জনৈক ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনকে গুলি করে ২০০ ভরি স্বর্ণ লুটে নেয় ডাকাতদল। ঘটনার রেশ না কাটতেই মোহাম্মদপুরের রাস্তায় নারীদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। নগরবাসী যখন আতঙ্কগ্রস্ত, রাত ৩টায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার গতানুতিক বক্তব্যে রাজধানীবাসীর স্বস্তি ফেরেনি; বরং আতঙ্ক নিয়ে রাত কাটে।
রাতের রাস্তায় চলাচলে ভয় পান অনেক রাজধানীবাসী। বিশেষ করে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেশি থাকায় জরুরি কাজে এই সময়ে রাস্তায় বের হতে ভয় পায় মানুষ। গতকাল আখতারুজ্জামান আজাদ নামে এক ব্যক্তি জানান, চট্টগ্রামের বাস থেকে সোমবার ভোর সাড়ে ৫টায় ঢাকায় নামেন। বাস থেকে নেমে কাউন্টারেই বসে থাকেন। আলো ফোটার আগে বাসায় রওনা দেননি। বলাই বাহুল্য যে, রওনা দেননি ছিনতাইয়ের আশঙ্কায়।
রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে চুরি-ডাকাতির ঘটনা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। ঢাকা-রাজশাহী রুটের চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনার রেশ না কাটতেই সাভারের আশুলিয়ায় নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হন ছোট পর্দার অভিনেতা আজিজুর রহমান আজাদ। এ সময় আহত হন অভিনেতার মা আজিজুন্নাহার ও স্ত্রী রোকসানা হক। পরিবারের সদস্যরা জানায়, ভোরে কয়েকজন ডাকাত রান্নাঘরের গ্রিল কেটে বাসায় ঢুকে। ডাকাতের উপস্থিতি টের পেলে ধস্তাধস্তি হয়। এরপর আজাদকে লক্ষ্য করে গুলি করে ডাকাতরা। এ সময় আজাদের পায়ে তিনটি গুলি লাগে।
ডাকাতের আক্রমণে আজাদের মা পায়ে ও স্ত্রী মাথায় গুরুতর আঘাত পান। রবিবার রাত ২টার দিকে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়ায় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে একদল ডাকাত ঢুকে লুটপাট করে। এর আগে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরের এ ব্লকের একটি মুদি ও একটি বিরিয়ানির দোকানের শাটারের তালা কেটে চুরির ঘটনা ঘটে।
এই অবস্থায় গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, মানুষকে আশ্বস্ত করতেই আজকে (সোমবার) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সভা করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে আপনারা পরিস্থিতি টের পাবেন।
সরকারের সদিচ্ছা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টা সত্যেও অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মাঠ পুলিশের একাধিক সদস্য বলেন, পুলিশের সাধারণত এলাকার প্রত্যেকটি মানুষের হাঁড়ির খবর মুখস্ত থাকে। তবে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সব এলোমেলো হয়ে যায়। গণবদলির কারণে ঢাকার বাইরে থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের বড় ধরনের অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। মফস্বলের সঙ্গে ঢাকার অপরাধের ধরনও আলাদা। পুলিশের বহু বছরের গড়ে তোলা সোর্স সিস্টেম ভেঙে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে অভিযানে গিয়ে পুলিশ পথ হারিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটছে। পরে অন্য ফোর্স নিয়ে খুঁজে তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। এখন পুলিশের দৃশ্যমান কাজ বাড়ানো হচ্ছে। চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি প্যাট্রোল ও চেকপোস্ট বাাড়নো হয়েছে। দ্রুতই ইতিবাচক ফলাফল আসবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ঢাকায় যেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, সেসব জায়গায় প্যাট্রোল বাড়বে। সোমবার সন্ধ্যা থেকে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও নৌবাহিনীর যৌথ প্যাট্রোল শুরু হবে। পুরো ঢাকা শহরে অনেক জায়গায় চেকপোস্ট (তল্লাশিচৌকি) বসবে। আইনশৃঙ্খলা নজরদারি করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ থেকে বিরত রয়েছে। অভিজ্ঞতার অভাবও রয়েছে। কেউ কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে না। আবার সরকারকে অস্থিতিশীল করতে একটি অংশ পরিকল্পিতভাবে অপরাধ করে যাচ্ছে। অপরাধ করার জন্য অর্থেরও জোগান দেওয়া হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, ছিনতাইয়ের নামে যে খুনখারাবি-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে; সেটা খুবই পরিকল্পিত। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা ছিনতাইকে পুঁজি করে দেদার সহিংসতা ঘটাচ্ছে। জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, দেশকে অস্থিতিশীল করছে। ভুলে গেলে চলবে না, আওয়ামী লীগের মেয়র জাহাঙ্গীর কয়েকদিন আগে বলেছিল, যে শহরে আমরা থাকতে পারব না; সে শহরের মানুষকে আমরা ঘুমাতে দেব না। কারা পরিকল্পিতভাবে এসব সহিংসতা ঘটাচ্ছে, সেটা না বোঝার কোনো কারণ নাই। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে হার্ডলাইনে যেতে হবে। যে কোনোভাবেই হোক খুনিদের চক্রান্ত ভেস্তে দিতে হবে, জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।
চুরি-ছিনতাই প্রতিরোধে কয়েকটি স্থানে রাতে পাহারা বসিয়েছেন এলাকাবাসী। তারা পালাক্রমে এলাকা পাহারা দিচ্ছেন। জানা গেছে, স্বর্ণ ডাকাতির হওয়ার পর সোমবার রাত থেকেই স্থানীয় যুবকদের সমন্বয়ে রাতভর সম্মিলিত পাহারার উদ্যোগ নিয়েছেন বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেদেরই করছেন। ব্লকভিত্তিক পালাক্রমে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।